
হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের ঐক্য তৈরি হলে গত ছয় মাসে অনৈক্যের সুর দেখা গেছে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে একসময় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যথেষ্ট সমঝোতা ছিল। দল দুটি একই জোটে থেকে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে এই দল দুটির সক্রিয় সমর্থন ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজপথে বেশ কাছাকাছি ছিল এই তিনটি পক্ষই। তবে হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পর এখন জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির একধরনের দূরত্ব বেড়েছে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত দলগুলোর মধ্যে ঐক্য কিছুটা হলেও বিনষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে মুক্তমনে খোলামেলা কথা বলা যাচ্ছে, রাজনীতির জন্য এটাই সবচেয়ে বড় উপাদান। জনগণ সাহস করে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারছেন। এটা তো রাজনীতির জন্য বড় পাওয়া। এ ছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন-নিপীড়নও নেই।’ তিনি বলেন, ‘যাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করা হচ্ছে, তারা তো ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ছিলেন। তারা তাদের অপরাধ অনুযায়ী আইনি শাস্তি পাবেন, এটা তো স্বাভাবিক। তবে গত ছয় মাসে রাজনৈতিক বিতর্ক বেড়েছে।’
ড. মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, “আমি মনে করি, অনেক ক্ষেত্রে এই বিতর্ক অপ্রত্যাশিত। মূলত, রাজনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময় না থাকার কারণে এসব বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু এই বিতর্কগুলো বড় কোনো বিতর্ক নয়, আলাপ-আলোচনা করলেই সমাধান হয়ে যাবে। এই বিতর্ক না থাকলে ভালো হতো। কারণ ভারতে বসে শেখ হাসিনা তার ‘হারানো স্বর্গ’ উদ্ধার করতে নানা ষড়যন্ত্র করছেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করে ফেলা উচিত।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। মনে রাখা দরকার, এই সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে। বিশেষ করে আমাদের নির্বাচনিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, গণতান্ত্রিকব্যবস্থা অকার্যকর, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠাগুলো দলীয়করণ হয়ে পড়েছে, ব্যাংক লুটসহ সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই সরকার সবকিছু ভালো করেছে, নিঃসন্দেহে তা না।’
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো করেছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে। ফলে সরকারের আরও সতর্ক থাকা দরকার।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যা করণীয় তা তারা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের কারণে সরকার তাদের দায়িত্ব বা ইচ্ছামতো কাজ করতে পারছে না। ফলে মানুষের মধ্যে কিছুটা হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন। ইতোমধ্যে তারা ঘোষণা দিয়েছে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে। দ্রুতই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দিকে যেতে হবে এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন- জনগণ তা মোকাবিলা করবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত বা প্রক্রিয়াগত কারণে সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না- তা কিন্তু নয়। নানা মত ও পথ থাকবে। তবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সবাইকে একমত থাকতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এখনো তো দেশে রাজনীতি নেই। কার বিরুদ্ধে রাজনীতি করব। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক সরকার নয় বলে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা সমালোচনা করতে পারছি না। তবে জনগণের চাওয়া একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবী বদলে গেছে, তুমি আর আমি আগে যা ছিলাম, তাই আছি। সচিবালয়সহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতি কমেনি বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। তদবির বাণিজ্য চলছে। ফলে এসব সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে রাজনীতিতে হিংসা-প্রতিহিংসা ও সহিংসতা রোধ করা যাবে না। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না হলে যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরে থাকব।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সবার মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপতি। পরদিন ৬ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছাত্রনেতৃত্ব ও তিন বাহিনীর প্রধান করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়। ৮ আগস্ট দুপুরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান ড. ইউনূস এবং রাত ৯টা ১৫ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন তিনি। এরপর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের দল জাতীয় নাগরিক কমিটি, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে সব দলই অন্তর্বর্তী সরকারকে সাপোর্ট ও সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। গত ছয় মাসে বিভিন্ন ইস্যুতে তিন দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
গত ছয় মাসে বেশ কিছু ইস্যু সামনে আসে। নির্বাচন না সংস্কার- কোনটি আগে? রাষ্ট্রপতির অপসারণ, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রসহ কয়েকটি ইস্যুতে সরকার ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে এই বিভেদ বা মতবিরোধ আরও কিছুটা স্পষ্ট হয়। ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়ে ড. ইউনূসের সর্বশেষ মন্তব্যে বিষয়টি আরও একটু স্পষ্ট হয়। তবে বিএনপির কৌশলের কারণে ইস্যুটি এখনো তীব্র মতবিরোধে রূপ নেয়নি। রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বিএনপি একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায়ের পক্ষে। কারণ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করেন।
জামায়াত নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও তারা সংস্কারের জন্য সরকারকে বেশি সময় দিতে চায়। দলটি মনে করে, অনেক দেরিতে নির্বাচন হলে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিএনপি বেকায়দায় থাকলে জামায়াতের ভোট বাড়বে বলে মনে করেন ইসলামপন্থি এই দলের নেতারা। এই কারণে আগে সংস্কার পরে নির্বাচনের পক্ষে জামায়াত। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দল যেহেতু ভিন্ন, তাই দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। তবে জাতীয় স্বার্থে দলীয় স্বার্থ না দেখাই ভালো। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্য থাকতে হবে। যারা গত ছয় মাসের জাতীয় ঐকমত্য ধরে রাখতে পারেনি এটা তাদের ব্যর্থতা। কেন পারেনি এটা তারাই ভালো বলতে পারবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐকমত্য জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐকমত্য অটুট রাখা দরকার।’
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন উপদেষ্টা এখনো সরকারে রয়েছেন। নতুন দল গঠন করে তারা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইছেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি এবং বিএনপির আগের সরকারের কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণ তাদের গ্রহণ করতে পারে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ছাত্রদের নতুন দল আসছে। তবে রাজনৈতিক যে ঐক্য ছিল তা অনেকটাই বিনষ্ট হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ধরে রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থরক্ষার জন্যই দরকার। আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীলভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে।’
এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা রয়েছে। যদিও এমন অস্থিরতা প্রত্যাশিত ছিল না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো করতে হবে। একটা সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’
গত ছয় মাসে নির্বাচন আগে- নাকি সংস্কার আগে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তিন দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনে একজোট হয়ে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দিন দিন বাড়ছে দূরত্ব। বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। আলাদা বলয় গঠনে নিজেদের মতো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দল দুটি। নতুন দল গঠনের দ্বারপ্রান্তে ছাত্রনেতৃত্ব। তবে নির্বাচন নিয়ে অশ্চিয়তা দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও প্রধান উপদেষ্টা গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, চলতি বছরের শেষ দিকেই হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।