
বাবা-মা তথা স্বজনদের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে শিশু-কিশোর বা উঠতি বয়সীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ অপব্যবহার ও পারিবারিক-সামাজিক উদাসীনতায় ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে কিশোর বয়সীরা। মনোজগতের পরিবর্তনে তারা অনেক সময় নিজের বাবা-মা, পরিবার, স্বজন, সহপাঠী-বন্ধু সবকিছুর মায়া বা বলয় ত্যাগ করে ভিন্ন কোনো নতুন পথকে বেছে নিচ্ছে অনায়াসে। এ যেন গোলকধাঁধার চক্করে পড়ার মতো অবস্থা।
ঢাকার আদাবর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকের সূত্রে এক যুবকের সঙ্গে ১১ বছরের আরাবি ইসলাম সুবার আত্মগোপনে যাওয়ার ঘটনা সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। যাদের ঘরে শিশু-কিশোর বয়সী সন্তান রয়েছে, তাদের মনে এই ঘটনা চরম উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু উঠতি বয়সী শিশুদের ভুল পথে পা বাড়ানোর জন্য দায়ী কে বা কারা, সেটাও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের ভুল পথে পা বাড়ানোর পেছনে এককভাবে কেউ দায়ী নন। বাবা-মা, পরিবার, সমাজ- সবারই দায় আছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার অন্যতম সমস্যা। সঙ্গদোষে বা নানা কারণে উঠতি বয়সী শিশু-কিশোররা অনেক সময় বিপথগামী হয়ে উঠছে। ফলে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কোনো ভুলে জড়িয়ে যাচ্ছে কি না, সেগুলো ভালোভাবে তাদের সঙ্গে মিশে দেখভাল করতে হবে। শিশুদের মানসিক বিকাশের বাধাগুলো দূর করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার আদাবর থেকে আত্মগোপনে যাওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুবাকে গত মঙ্গলবার নওগাঁর এক যুবকের বাসা থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধারের পর সুবা বলছিল, বাসায় তার ভালো লাগে না, তাই মোমিনের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিল। টিকটকের সূত্রে নওগাঁর বাসিন্দা মোমিন হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। এমনকি বাবা-মাসহ স্বজনদের উৎকণ্ঠায় ফেলে এভাবে আত্মগোপনে যাওয়ার পরও সুবা কথা বলতে গিয়ে বারবার খিলখিল করে হাসছিল। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশু সুবার এই ঘটনায় মূলত সারা দেশেই সচেতন অভিভাবকদের মনে নতুন উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সুবাকে প্রতীক ধরে অনেকে নিজের সন্তানের বিষয়েও চিন্তায় পড়ে গেছেন। অনেকের সঙ্গে কথা বলে এটা জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে দুই কন্যা সন্তানের বাবা আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা ফজলুল হক গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান সময় ও প্রেক্ষাপটে অভিভাবক বা বাবা হিসেবে সন্তানদের নিয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তায় সময় পার করতে হচ্ছে। ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো অভিভাবকদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু অনেক অভিভাবক এসব বিষয়ে উদাসীন। সন্তানরা ছোট মানুষ হিসেবে ভুল করতে পারে, ভুল চিন্তাকে সঠিক ভাবতেই পারে, সেখানে বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সেটা আমরা অনেকেই করি না। এই উদাসীনতার কারণে অভিভাবকদের কখনো কখনো বড় খেসারত দিতে হয়।’
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, পারিবারিক বন্ধন, অনুশাসন, মায়াসহ গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ধীরে ধীরে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীসহ সবার মধ্যে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশু-কিশোরদের মনোজগতেও বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। কোনটি ইতিবাচক আর কোনটি নেতিবাচক, সেটা তারা বুঝতে পারছে না। সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য বাবা-মাকে বাগানের মালির মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। সব সময় পরিচর্যার মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয় না। আবার অনেক সময় পরিচর্যা বা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে শিশুদের ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন। বাধ্য করছেন বা অধিক কঠোরতা দেখাচ্ছেন। এগুলো শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য-বিকাশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
শিশু সুবার প্রসঙ্গ টেনে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ওই শিশুটি বলছিল তার বাসায় ভালো লাগছিল না।’ এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ শিশুটির বাসা-বাড়িতে ভালো লাগছিল না কেন, সেটা উদ্ঘাটন করা দরকার। কেবল সুবার ক্ষেত্রে নয়, সব শিশু-কিশোরের বিষয়ে বলব, এটি গুরুত্বপূর্ণ। মোটকথা, শিশু-কিশোরদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। এককভাবে কাউকে দায়ী না করে বরং পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবারই এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, শিশু-কিশোরদের ভুল পথে যাওয়া বা অপরাধে জড়ানোর ক্ষেত্রে মূলত সমাজ ও পরিবারের দায় সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে সমাজ ও পরিবারের মধ্যে এখন নানা বিভাজন দেখা দিয়েছে। আগে গোত্রীয় বা বংশগত একধরনের বিভাজন দেখা যেত, আর এখন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে ভয়ানক রকম ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বা যোগসূত্র না থাকায় শিশু-কিশোররা ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে। কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মা তথা পরিবারের সদস্যদের ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হবে। সন্তানের মনোজগতে কী হচ্ছে, সেটা উপলব্ধি করতে হবে। পরিবার ও সমাজের প্রতি মূল্যবোধ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের বাধাগুলো দূর করতে পারলেই তারা ভুল পথে যাবে না বা উদ্বেগের কারণ হবে না।
এ বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (সাবেক আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘শিশু-কিশোর বা উঠতি বয়সীদের পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বা প্রধান ভূমিকা পরিবারের। যখন কোনো শিশু-কিশোর অপরাধে জড়িয়ে যায় কিংবা কোনো কারণে নিখোঁজ হয়, তখন সেখানে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা থাকে। তারপরও সচেতনতার অংশ হিসেবে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে পুলিশেরও কাজ করার সুযোগ আছে। অনেক সময় স্থানীয়ভাবে উঠান বৈঠক হয়। সমাজের গণ্যমান্যদের নিয়ে সভা-সেমিনার হয়, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নানা আয়োজন হয়ে থাকে। এসব আয়োজনে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশ, তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা কার্যক্রম চালানো যায়। যদিও এ ধরনের কিছু কাজ পুলিশ করেও যাচ্ছে বলেও শুনে থাকি।’