
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়েই সারা দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ বা শয়তান ধরার অভিযান। যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করছেন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছেন, তাদের এই অভিযানের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে অভিযানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অস্থিতিশীল এলাকাগুলোকে।
বিশেষজ্ঞরাও এই অভিযানকে ইতিবাচক এবং যৌক্তিক বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এই জাতীয় বিশেষ অভিযান ভালো উদ্যোগ। তবে এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযান যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরুর পর থেকে (শনিবার রাত থেকে রবিবার সন্ধ্যা) গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ হাজার ৩০৮ জনকে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল বলেছেন, ‘ডেভিল (শয়তান) নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।’ এ ছাড়া অভিযান পর্যবেক্ষণের জন্য গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকেই সব বাহিনীর সমন্বয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার চালুর কথাও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
যৌথ বাহিনীর দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের হয়ে যেসব সন্ত্রাসী-ক্যাডার বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে বা করার চেষ্টা করছে তাদের আটকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি অভিযানের তালিকায় থাকছে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ চিহ্নিত অপরাধীরাও। ডেভিল হান্ট পরিচালনায় গঠিত যৌথ বাহিনীর মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনী। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের মহানগর ও জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) শাখাগুলো এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী-অপরাধী শনাক্তে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে।
এ বিষয়ে গতকাল মুঠোফোনে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘যারা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করবে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে বা আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তারা যেই হোক, সবখানেই অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হবে।’
গতকাল এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে তাদের টার্গেট করে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলবে। ডেভিল (শয়তান) যতদিন শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত অপারেশন চলবে।’
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হয় তখন পুলিশকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হয়। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা বাড়ছিল, ফলে সেদিক থেকে এই অপারেশনের যৌক্তিকতা আছে। এতে অপরাধের সংখ্যা কমে আসবে বলেই স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায়। পরে এই অপারেশন যদি সফল হয় তখন একভাবে মূল্যায়ন হবে, আর সফল না হলেও আরেকভাবে মূল্যায়ন হবে। আপাতত ইতিবাচকভাবেই বিষয়টি দেখতে হবে।’
গণহারে গ্রেপ্তার বা সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়ে আলোকপাত করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘অনেক মামলায় আসামি হিসেবে গণহারে নাম দেওয়া হয়েছে, এটা খুবই অস্বাভাবিক। এতে করে মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনেকটা পিছিয়ে যায়। যারা অভিযান চালাবেন তাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজি মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই জাতীয় অভিযান অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সে জন্য প্রচুর গোয়েন্দা তথ্য বা মাঠপর্যায়ের অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ খুব জরুরি। প্রকৃতপক্ষে কারা কী করছেন সেটা একাধিক মাধ্যম থেকে যাচাই করে সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। কোনোভাবেই যেন নিরপরাধ বা নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হন সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।’
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান গতকাল সন্ধ্যায় খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর পর থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন বা মহানগর এলাকাগুলো থেকে ২৭৪ জনকে এবং রেঞ্জের অধীনে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১ হাজার ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘যেকোনো বিশেষ অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে হয়। এই অভিযানে কাকে ধরবে, কেন ধরবে এবং ধরার পর আইনগত পদক্ষেপ কী হবে- এই জাতীয় বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে হবে। কারা দেশকে অস্থিতিশীল করছেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছেন, তাদের তালিকা থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা অপরাধের ভিত্তিতে আটক করতে হবে। বিশেষ এই অভিযান যাতে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, প্রকৃত অপরাধী যাতে গ্রেপ্তার হয় এবং নিরীহ ব্যক্তিরা যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হন সেদিকেই যৌথ বাহিনীর নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
আবদুল কাইয়ুম আরও বলেন, “সরকারের ভেতরেই ‘ভূত’ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন রয়ে গেছেন বলা হচ্ছে। অবস্থা যদি এমনই হয়, তাহলে অভিযান কতটা কাজে আসবে সেটাও ভাবতে হবে। কেননা, সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও আইনশৃঙ্খলা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।’
গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, মূলত পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব এই ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালিত হচ্ছে। সেনাবাহিনী তাদের সাহায্য করছে। স্থিতিশীল পরিস্থিতি যাতে অস্থিতিশীল না হয়, তা নিয়ন্ত্রণই এই ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ মূল লক্ষ্য। এ জন্য অভিযান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার অনেক পরিকল্পনা নিয়েছে। তার একটা ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। এই অপারেশন যৌথভাবে সবাই মিলে একটা ‘ফোকাসড ওয়েতে’ করবে। তিনি বলেন, আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে পুলিশ বাহিনীর বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের নীতিগত ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, থানা পুড়ে গেছে, যে কারণে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন, ‘পৃথিবীর যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেসব দেশ পরাজিত শক্তিকে রাখেনি। কিন্তু আমরা অতটা অমানবিক হতে পারিনি।’
বিশ্লেষণে জানা গেছে, ইংরেজি শব্দ ডেভিল অর্থ শয়তান, আর হান্ট অর্থ শিকার। ফলে অপারেশন ডেভিল হান্টের অর্থ দাঁড়ায় শয়তান শিকারের অভিযান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত ডেভিল হান্ট বলতে দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের বোঝানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, প্রতিটি অপারেশনের একটি কোড নেম দেওয়া হয় অপারেশনকে ফোকাস করার জন্য।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এখন প্রধান ইস্যু। তাই যেকোনোভাবে সরকারকে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হবে। এখানে বর্তমানে জনসাধারণের নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠেছে, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র-গুলি লুট হয়েছে, সেগুলোর উদ্ধার করাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা ইতিবাচক। তবে এ বিষয়ে আরও কয়েক দিন পর্যবেক্ষণ করার পর পরবর্তী মন্তব্য করা যাবে।’
সব বাহিনীর সমন্বয়ে ‘সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার’ গঠন
অপারেশন ডেভিল হান্টের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব বাহিনীর সমন্বয়ে ‘সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার’ গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তিনি জানান, রবিবার (গতকাল) সন্ধ্যা থেকেই এই কমান্ড সেন্টার কাজ শুরু করবে। ফলে আইনশৃঙ্খলার দ্রুত উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করা হচ্ছে।
শফিকুল আলম জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সেন্টার সমন্বয় করবে এবং প্রতিটি বাহিনীর প্রতিনিধি সেখানে থাকবেন। এই কমান্ড সেন্টার নিয়মিত মনিটরিং করবে। কীভাবে কাজ করবে, তা ধাপে ধাপে জানা যাবে।