
‘আমরা সারা দেশে দিনে তিন হাজার টনের বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করছি। যা উৎপাদন করছি, তাই বাজারে ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের তেলের কোনো সংকট নেই।’ এভাবেই বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহের ব্যাপারে অভিমত প্রকাশ করেন সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা। সিটি গ্রুপ ছাড়াও টিকে, মেঘনা গ্রুপ এভাবে বাজারে তেল সরবরাহ করছে। প্রতিদিন দেশে এই নিত্যপণ্যের চাহিদা পাঁচ হাজার টনের মতো। কিন্তু রমজান ঘনিয়ে আসায় ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে উধাও হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ১৬৭ টাকার খোলা তেল ২১০ টাকা লিটার ছাড়িয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এত তেল যাচ্ছে কোথায়? তা দেখা দরকার। ক্রেতারাও বলছেন, বাজারে অভিযান না চালালে তেলের সরবরাহ বাড়বে না। গতকাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই জানায়, সারা দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। মাসে গড়ে লাগে দেড় লাখ টন। অর্থাৎ দিনে লাগে পাঁচ হাজার টন। রমজানে চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০ হাজার টন লাগে। কিন্তু সিটি গ্রুপেরই দিনে উৎপাদন হচ্ছে তিন হাজার টনের বেশি।
ভোজ্যতেল উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে রিফাইনারি কোম্পানি রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করছে।
সিটি গ্রুপের মতো টিকে গ্রুপ, মেঘনা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি তেল উৎপাদন করছে। তার পরও বাজারে তেলের সংকট লেগে থাকছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে মিলমালিকরা চাপ দিলে সরকার গত ৯ ডিসেম্বর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা, খোলা তেল ১৬৭ টাকা ও খোলা পাম তেলের দাম বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করে।
কিন্তু দুই মাস পার হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। সংকট কাটছে না। বিভিন্ন কোম্পানির পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও এক ও দুই লিটারের তেল মেলে না। আবার কোথায় পাওয়া গেলেও আটা, সুজি, ডাল ছাড়া বিক্রি করতে চাচ্ছেন না পাইকারি বিক্রেতা ও ডিলাররা। গত ৬ ও ২১ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
বিভিন্ন কোম্পানির ডিলার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এ জন্য আমরা আগের মতো পাচ্ছি না। আবার সামান্য পাওয়া গেলেও দাম বেশি দিতে হচ্ছে, কোনো লাভ থাকছে না। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গিয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর বাইরে সারা দেশেও একই দশা বলে জানা গেছে।
হাতিরপুল বাজারের মুদি বিক্রেতা আমির হোসেন বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি থেকে দেয় না।’ কারওয়ান বাজারের লক্ষ্মীপুর স্টোরের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ানোর পরও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ডিলাররাও বেশি দাম নিচ্ছেন।’
টাউন হল বাজারের বিসমিল্লাহ স্টোরের বিক্রয়কর্মী তামিম হোসেন বলেন, দাম বাড়ানোর পরও সহজে সয়াবিন তেল পাওয়া যায় না। সামনে রমজান। তাই সরকারের এটা দেখা দরকার। অভিযান করলে ধরা পড়বে। কে তেল লুকিয়ে রাখছে।
এ সময় তোহরুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কিছুদিন আগে লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তার পরও বাজারে তেলের সংকট। আবারও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের পকেট কাটার জন্যই এই কৌশল। তাই মিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুদামে অভিযান চালানো দরকার।
সিটি গ্রুপের মোহাম্মদপুরের ডিলার মেসার্স তাসমিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মাসুদ রানা বলেন, ‘মিল থেকে তেলের সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমরাও আগের মতো সরবরাহ করতে পারছি না। বিক্রি কমে যাওয়ায় লাভও কমে গেছে।’
এদিকে খোলা সয়াবিন তেলের মোকাম রাজধানীর মৌলভীবাজারেও তেলের সরবরাহ কমে গেছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘আগের মতো পাচ্ছি না। এ জন্য সংকট দেখা দিয়েছে।’ দামও একটু বেড়ে গেছে। সরকার খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭ টাকা ঘোষণা করলেও আমরা তা পাই না।’
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমরা যা উৎপাদন করছি তাই বাজারে ছেড়ে দিচ্ছি। অন্যরা কী করছে, তা বলতে পারব না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তা মনিটরিং করছে।’
টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘আমরা আগের মতোই তেল সরবরাহ করছি। অন্য কোম্পানি কী করছে, তা আমার জানা নেই। রমজানের জন্য সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। তেলের কোনো ঘাটতি দেখছি না।’
মেঘনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন ও তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘ফ্রেশ কোম্পানির তেলের কোনো সংকট নেই। আমাদের সক্ষমতা যা তাই উৎপাদন করছি, বাজারে ছেড়ে দিচ্ছি। গতকালও আমরা খোলা, বোতলজাত ও পাম তেল- প্রায় দুই হাজার টন বাজারে দিয়েছি।’
চাহিদার দ্বিগুণের বেশি বিভিন্ন কোম্পানির ভোজ্যতেল উৎপাদন হচ্ছে। তার পরও সংকট কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অয়েল রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘টিকে গ্রুপ যা উৎপাদন করছে, তাই সরবরাহ করছে। অন্যরা কী করছে, তা বলতে পারব না।’
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরাও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখছি ভোজ্যতেলের সংকট শুরু হয়েছে, বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ জন্য রবিবার মিল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার মনিটরিং শুরু হয়েছে। আজ (সোমবার) রিপোর্ট হাতে পাব। কারও বিরুদ্ধে মজুতদারির অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’