
অপারেশন প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন না হওয়ায় গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত টানা আট মাস বেতন পাচ্ছেন না কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি)। বেতন না পাওয়ায় তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করছে। কিন্তু আর নয় হতাশা! সিএইচসিপিদের জন্য আসছে বিরাট সুখবর! আগামী মাসে (মার্চ) রাজস্বকরণ খাতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। তখন একবারে ৯ মাসের বকেয়া বেতন পাবেন তারা। এ ছাড়া সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে শুধু রোগের চিকিৎসা নয়; রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিয়ে বেশি কাজ হবে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট প্রবিধানমালা তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হলে সিএইচসিপিদের উপজেলা ও জেলা পর্যায় পর্যন্ত পদায়নও করা হবে।
দেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। দুর্গম এলাকায় আরও এক হাজার স্থাপন করা হবে। ইউনিয়ন সাব-সেন্টার রয়েছে ১ হাজার ৩৬২টি। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ২৭ প্রকার ওষুধ দেওয়া হতো। এখন ২২ প্রকার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক বাদ দেওয়া হয়েছে। কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিসের ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন সবগুলো থেকেই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এখান থেকেই রোগী রেফারেল শুরু হবে। সপ্তাহে দুই দিন দুজন করে ডাক্তারও বসবেন। তারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রেফারেল রোগী দেখবেন। টারসিয়ারি লেভেলে চাপ কমানোর জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক শক্তিশালী করা হবে। সে জন্য যত ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে সিএইচসিপিদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে প্রথমে রাজস্বকরণ ও পরে পদায়নের কথা ভাবছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএইচসিপিদের সঙ্গে স্থানীয়দের যোগাযোগ ভালো রয়েছে। তাদের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা হবে। তারা তিন মাসের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাদের আরও বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যাতে তারা রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারেন।
জানতে চাইলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ডক্টর আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘রাজস্বকরণে শুধু একটা ধাপ বাকি আছে। ১৩ হাজার ৯২৬ জনের একটা তালিকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। উপদেষ্টা সময় দিলে একটা মিটিং করা হবে। মিটিংয়ের পর নোটিফিকেশন হবে। নোটিফিকেশনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় বেতনের টাকা কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের ফান্ডে পাঠাবে। মনে হচ্ছে এটা মার্চের মধ্যে হবে। তখন বকেয়া সব বেতন তারা একবারে পাবেন। তারা আগে ১৪তম গ্রেডের বেতন পেতেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১৬তম গ্রেড করা হয়েছে। রাজস্বকরণ হলে তারা ১৬তম গ্রেডেই বেতন পাবেন।’
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি উজ্জ্বল বলেন, ‘জুন মাস থেকে বেতন পাচ্ছি না। কবে নাগাদ পাব তাও জানি না। মানসিকভাবে খুবই হতাশার মধ্যে রয়েছি। কয়েকজন সিএইচসিপির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন বেতন পাচ্ছেন ১৬ হাজার ৭০০ টাকা করে। আর যাদের সন্তান আছে, তারা সন্তানের জন্য আলাদা ভাতা পান।’
কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও টেকসই করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট বিল পাস হয়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
এ প্রসঙ্গে ট্রাস্টের সভাপতি ডক্টর আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করছি। তা হলে প্রবিধানমালা তৈরি করা। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর যে আইন হয়েছে তার কোনো রুল নেই। সব সময় আইনের পর একটা রুল হয়। রুলের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) মিটিং হবে এবং মিটিংয়ে সিএইচসিপিদের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। রুল হয়ে গেলে ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।’
প্রবিধানমালায় কী থাকবে- সেই প্রসঙ্গে আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘তারা কোন ধরনের কাজ করবেন, তাদের ক্যারিয়ার লেটারটা কেমন হবে? যেমন আমরা সাজেস্ট করব প্রমোশন দিয়ে সিএইচসিপিদের অন্তত উপজেলা- জেলা পর্যায় পর্যন্ত আনার। শুধু ওদের দিলে হবে না। এর সঙ্গে যারা হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অন্য পদে আছেন, তাদের নিয়েও চিন্তা করতে হবে। শুধু একদিকে প্রমোশন দিলাম আর অন্যদের দিলাম না, তা হবে না। সবার কথাই চিন্তা করতে হবে।’
যারা কর্মরত, তারাই থাকবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ বাদ পড়বে না। মানবিক কারণে বাদ দেওয়া হবে না। কোভিড-১৯-এর সময় তারা ফিল্ডে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন।’
সিএইচসিপিদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা বলছে দুই বছর প্রশিক্ষণের কথা। আমরা চেষ্টা করব যারা ফিল্ডে কাজ করেন তাদের জন্য দুই বছর হতে পারে। আর যারা চৌকস, দক্ষতা আছে, তাদের ইন্টারভিউ করে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাঠাতে পারি সেটাও ভাবছি।’
কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই ধাপে ধাপে রেফারেল হয়ে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রেফারেলটা একটা প্যাকেজের আকারে আসবে। ইমার্জেন্সি ছাড়া বিনা রেফারেলে কোনো রোগী যদি ওপর দিকে যায়, তাহলে তার ক্ষেত্রে বলব ১০ টাকার টিকিটের পরিবর্তে ১০০ টাকা নেওয়ার। কমিউনিটি ক্লিনিকে যাবে, ইউনিয়নে যাবে, উপজেলা-জেলায় এভাবে রেফারেল হয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রথম কথা হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া, পুষ্টি শিক্ষা দেওয়া, রোগ কেন হয় সেটা বোঝানো, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত সেটা বোঝানো। আমাদের শুধু রোগভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে স্বাস্থ্যভিত্তিক। অর্থাৎ দেখলে মনে হয় ভালো আছে, কিন্তু তাদের আমরা বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলছি। গর্ভবতী মা, শিশু, বৃদ্ধ এদের আপাতত সুস্থ দেখালে তাদের মাঝে মাঝে বলব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। কমিউনিটি ক্লিনিক মূলত রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিয়ে বেশি কাজ করবে। এটা ঠিকমতো করতে পারলে টারসিয়ারি লেভেলে চাপ কমে যাবে। চিকিৎসার ব্যয়ও অনেক কমে যাবে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গর্ভবতী ও প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, পুষ্টিসেবা, ইপিআই, সাধারণ রোগ ও জখমের চিকিৎসাসেবা, অসংক্রামক রোগ শনাক্তকরণ ও রেফারেল, কিশোর-কিশোরী ও নববিবাহিত দম্পতিদের সেবা, কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও টিকা দিতে সহযোগিতা দেওয়া, স্তন ও জরায়ুমুখে ক্যানসার প্রতিরোধ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভায়া স্ক্রিনিং, রেজিস্ট্রেশন করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণ, জরুরি ও জটিল রোগীর রেফারেল সেবা, স্বাভাবিক প্রসব (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্ম এলাকার জনগণকে খানাভিত্তিক অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও হেলথ আইডি কার্ড দেওয়া- এসব সেবা কমিউনিটি ক্লিনিকের আওতাভুক্ত।