
আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ হয়নি ১৩ বছরেও। দীর্ঘ এই সময়ে আলোচিত মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদনই জমা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও বিচার এখনো দুরাশায় পর্যবসিত।
থানা পুলিশ, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব হয়ে বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বর্তমানে পিবিআই নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স করছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, কী কারণে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড- সে বিষয়ে এখনো কিছুই জানা যায়নি। বিগত ১৩ বছরে শতাধিকবার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ। তবে গত নভেম্বর থেকে গতকাল (১০ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত পিবিআইয়ের টাস্কফোর্স এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান, তার ভাই মাকসুদুর রহমান, সাংবাদিক জ ই মামুন, মনজুরুল আহসান বুলবুলসহ অন্তত ৬২ জনের বক্তব্য নিয়েছে। এর বাইরেও র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বর্তমানে কারাবন্দি চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বক্তব্য নিয়েছে টাস্কফোর্স।
আজ সেই ১১ ফেব্রুয়ারি। ২০১২ সালের এই দিনে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নির্মম-নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়েও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামি শনাক্ত হয়নি। এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ এ পর্যন্ত ১১৫ বার পেছানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি পিবিআইয়ের প্রতিবেদন জমা দেওয়া কথা থাকলেও জমা দেয়নি তারাও। আগামী ২ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন দিন ঠিক করেছেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
গতকাল আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি জানতে ধানমন্ডিতে অবস্থিত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান কার্যালয়ে গেলে দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খবরের কাগজের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তদন্ত নিয়ে তারা আলাপ করলেও গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
পিবিআইয়ের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, অতীতে এই মামলার তদন্ত পুলিশের তিনটি ইউনিট করেছিল। পরে আদালতের নির্দেশে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেওয়া হয়। গত বছরের ৪ নভেম্বর এই মামলার কেস ডকেট হাতে পেয়েছে পিবিআই। এরপর থেকে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এই মামলার তদন্তের স্বার্থে ৬২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৬২ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন- এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও তার ভাই মাকসুদুর রহমান, সাংবাদিক জ ই মামুন, মনজুরুল আহসান বুলবুল, জিয়াউল আহসান (র্যাবের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান), সামিউর রহমান, মাহমুদুর রহমান, রেজা (মাছরাঙা), শামসুদ্দিন ডালিম, বাড়ির দারোয়ান, সাগর-রুনির ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ, রুনির ভাই ও ভাবি। এ ছাড়া আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাগর-রুনি উভয়ের কর্মস্থলের সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যার কাছে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বা যাচ্ছে এবং যারা ধারণা পোষণ করছেন সবাইকে তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পিবিআই টাস্কফোর্স।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্যরা গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে পিবিআই কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গত ১৫ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলগেটে সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসানকে দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি তৎকালীন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক ছিলেন। ঘটনার পর তিনিও সাগর-রুনির বাসা পরিদর্শন করেছিলেন।
এ বিষয়ে রুনির ভাই নওশের আলম খবরের কাগজকে বলেন, পিবিআই আমাদের ডেকেছিল। তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তবে তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য পিবিআইকে ৬ মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অপেক্ষা ছাড়া এখন কিছুই করার নেই।
পিবিআইয়ের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পিবিআই এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। তবে এ ঘটনায় আগে ৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল। তাদের মধ্যে রুনির পূর্বপরিচিত তানভীর আহমেদ এবং বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। অন্য নিরাপত্তাকর্মী এনামুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের শুনানির অপেক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাকি পাঁচজন চুরি, ডাকাতির অভিযোগ ও অন্য একটি খুনের মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
এই ঘটনায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। মামলার চার দিন পর (২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পুলিশ। এরপর আদালত মামলা তদন্তের জন্য র্যাবকে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া নিয়ে শুরু হয় কালক্ষেপণ। দীর্ঘ সময় পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ এ পর্যন্ত ১১৫ বার পিছানো হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাহির সরওয়ার মেঘের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। ওই প্রতিবেদনে র্যাব আরও জানিয়েছিল, তখন ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবে। ডিএনএ প্রতিবেদনে ঘটনাস্থলে অজ্ঞাত দুই পুরুষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়। তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। অবশ্য র্যাবের পক্ষ থেকে খুনের কারণ সম্পর্কে আদালতকে আর কোনো তথ্য জানানো হয়নি। যদিও খুনের ঘটনায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা হয়নি।
নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)সহ গোটা সাংবাদিক সমাজ আজও সোচ্চার। সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে প্রতিবছরের মতো আজও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছে পেশাদার সাংবাদিকদের বড় সংগঠন- ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। আজ (মঙ্গলবার) বেলা ১১টার দিকে ডিআরইউ চত্বরে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।