
‘এক যুগেরও বেশি আগের কথা (২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি)। শীত প্রায় শেষের দিকে, ফাল্গুন এল বলে। কিন্তু রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। সে রাতে ঘুম আসছিল না। মনে হচ্ছিল- সাগর গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসছে। মনে হচ্ছিল ফোনের রিং বাজছে। বাড়িতে ঢুকছে। মা বলে ডাকছে। এভাবে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ভোর হয়। কিন্তু আমি বুঝতেই পারছিলাম না যে, আমার ছেলে-বউমা লাশ হয়ে গেছে। সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ ফোন আসে। ফোনের অপর পাশ থেকে একজন বলতে থাকেন সাগর ও রুনী আত্মহত্যা করেছেন। এমন কথা শোনার পর আমি ‘ও সাগররে’ বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর আর কিছু মনে নেই।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খবরের কাগজকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির। একই সঙ্গে নির্মম হত্যার শিকার হন সাগরের স্ত্রী সাংবাদিক মেহেরুন রুনী। এই সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যার ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ১১ ফেব্রুয়ারি।
২০১২ সালের এই দিন ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনী। রাতে ঘটে এ ঘটনা। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও খুনিরা এখনো অধরা।
দীর্ঘ এক যুগেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহত সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, ‘এক যুগ পার হয়ে গেছে সাগর-রুনীর হত্যার। এখন পর্যন্ত আমার ছেলের হত্যাকারী কে সেটাই জানতে পারলাম না। আমারও বয়স হয়েছে, বেশি দিন আর বাঁচব না। ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি দেখে যেতে হয়তো পারব না। তবে এত নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের একবার দেখতে চাই। কেমন তাদের চেহারা। এক মায়ের সন্তান হয়ে আরেক মায়ের বুক কীভাবে তারা খালি করে।’
সাগর-রুনীর খুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে টেলিফোনে খবর পেয়ে প্রথমে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর পাগলের মতো ছেলের বাসায় ছুটে যাই। সে দিনের সব কথা মনে আছে। ডাইনিং টেবিলে চারটি প্লেটে খাবার ছিল। মেঝেতে পড়ে ছিল সাগর-রুনীর নিথর দেহ। এটা ডাকাতি বা চুরির ঘটনা না। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকারীরা সাগর-রুনীর পরিচিত ও কাছের মানুষ ছিল’ বলতে বলতে চোখ মোছেন তিনি।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরার কথা বলেছিলেন। ওই ৪৮ ঘণ্টায় ধরার বদলে খুনিদের আড়াল করা হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাইনি। প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখব, ওই দিন কবর জিয়ারত করব।
তিনি বলেন, ‘একযুগ পার হয়েছে সাগর-রুনীর হত্যার। এখন পর্যন্ত হত্যাকারী কে সেটাই জানতে পারলাম না। আমার একটাই কথা, ছেলের হত্যাকারীদের দেখতে চাই।’
পুরান ঢাকার নবাবপুরের ৬ নম্বর রোডে একটি দোতলা বাড়িতে ৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন সাহেলা মনির। এই বাড়িতে স্বামী মনির হোসেন মণ্ডল ও ছেলে সাগরের অনেকে স্মৃতি। সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের শৈশব, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে এই এলাকায়। পুরোনো অ্যালবামে ছেলের ছবি দেখে নীরবে চোখের জল ফেলেন সালেহা মনির।
তিনি বলেন, ‘সাগর খুব মেধাবী ছিল, স্কুলে অনেক পুরস্কার পেয়েছে সে। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়ার শখ ছিল, কিন্তু আমাদের সামর্থ্য ছিল না, পড়াতে পারিনি’- বলতেই দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে এই মায়ের। তিনি বলেন, ‘সাগর ও আমার স্বামীর অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়িতে। এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। স্মৃতি নিয়ে এই বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।’
সালেহা মনির বলেন, ‘আমার চার মেয়ে। একমাত্র ছেলে সাগর। ছেলের অনেক স্মৃতি। এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না।’ যুদ্ধের বছরে বর্ষা ঋতুতে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নানাবাড়ি জন্মেছিল সাগর সরওয়ার। বর্ষার দিনে জন্মেছিলেন বলে নাম রাখা হয়েছিলো সাগর বলতেই দুচোখ ভিজে আসে এই মায়ের।
সাংবাদিক সাগর-রুনী যখন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তখন তাদের একমাত্র ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘের বয়স মাত্র সাড়ে ৫ বছর। বাবা-মা নিহত হওয়ার পর থেকে মেঘের দেখভাল করছে মামা নওশের আলম রোমান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘মেঘ ভালো আছে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ও-লেভেল শেষ করে এখন এ- লেভেল পড়ছে। আগে ক্রিকেট খেলায় বেশ মনোযোগ বাড়ালেও এখন পড়াশোনায় সময় বেশি দিচ্ছে।’