
যাত্রীর পাসপোর্ট ও বিস্তারিত তথ্য ছাড়া আর কোনোভাবেই বিমান বা যেকোনো ফ্লাইটের টিকিট বুক করা সম্ভব হবে না। এমনকি গ্রুপ টিকিটের ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে। এর আওতায় এজেন্সি কিংবা এয়ারলাইনসও আর বিনা পাসপোর্টসহ অন্যান্য তথ্য ছাড়া বিমানের টিকিট নিজ কবজায় রাখতে পারবে না। এর ফলে ফ্লাইটের টিকিটে কৃত্রিম সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। পাশাপাশি বিমানবন্দরের হ্যাঙারের (যেখানে উড়োজাহাজ রাখা হয়) ভাড়া কমানোরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই দুটি পদক্ষেপের ফলে অচিরেই বিমানের তথা উড়োজাহাজের যাত্রী ভাড়া কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত দুই মাসে এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বিমান ভাড়া যেন কিছুটা কমে আসে সে বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়। দ্রুতই এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও ভ্রমণবিবরণী ছাড়া টিকিট বুকিং করে উড়োজাহাজের টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরির পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেখানে পাসপোর্ট বা যাত্রীর বিস্তারিত তথ্য ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে একশ্রেণির এজেন্সি ও এয়ারলাইনসের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে টিকিট বুক করে আটকে রেখে দাম বাড়িয়ে চড়া মূল্যে বিক্রি করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিমানের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হিসেবে ওই সিন্ডিকেটকরণকে মনে করা হয়। এ বিষয়ে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর পক্ষ থেকে নানা সময় সরকারের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে আটাব সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে এ আবেদন জানিয়ে আসছি। যেন যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও ভ্রমণবিবরণী ছাড়া এয়ারলাইনস বা এজেন্সি কোনো টিকিট বুকিং দিতে না পারে। এটি কার্যকর হলে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা আর সম্ভব হবে না। বিমান টিকিটের দাম বৃদ্ধির এটি একটি বড় কারণ। এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে টিকিটের দাম বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ে বিমান টিকিটের উচ্চমূল্য পর্যালোচনাসহ যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় গত বৃহস্পতিবার ৬ ফেব্রুয়ারি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, পাসপোর্ট কপি ছাড়া যেন টিকিট বুকিং করা না যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ থেকে বুকিং করা টিকিট-পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইস্যু না করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারলাইনস সেই টিকিট বাতিল নিশ্চিত করবে।
আর ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এয়ারলাইনস বা ট্রাভেল এজেন্সিকে গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে ব্লক করা টিকিট আগামী সাত দিনের মধ্যে ভ্রমণকারী যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বরসহ (পাসপোর্টের কপিসহ) টিকিট ইস্যু নিশ্চিত করতে হবে। না হলে তিন দিনের মধ্যে এয়ারলাইনস তা বাতিল নিশ্চিত করবে।
ওই বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ছয় মাসে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র সচিবকে সভাপতি করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে গত ছয় মাসে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে যাবতীয় বিষয় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সংস্থা/ব্যক্তিকে শাস্তির জন্য সুপারিশ করতে বলা হয়েছে এবং টিকিটের উচ্চমূল্যের বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ১৩ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এসব সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে মঞ্জুরের অপেক্ষায় আছে এখন। সেখান থেকে ইতিবাচক উত্তর এলেই এ বিষয়ে নতুন নির্দেশনা আসবে এয়ারলাইনস ও এজেন্সিগুলোর ওপর।
এদিকে বিমানের টিকিট মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ হিসেবে বরাবরই বিমানবন্দরগুলোর বিভিন্ন চার্জকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের বিকাশ এবং সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য ইজারামূল্য নির্ধারণের সময় ১৫ বছর পে-ব্যাক পিরিয়ড ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে হ্যাঙারের নির্মাণব্যয় এবং উচ্চতা বেশি হওয়ায় ইজারার হার তুলনামূলক বেশি ছিল। হ্যাঙারের অবস্থান এবং অন্যান্য কারণে এয়ারলাইনসগুলোর অতিরিক্ত খরচ বৃদ্ধি পায়, যা তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়ায়। আর এর প্রভাব পড়ে বিমানের টিকিটের দামের ওপর।
এ বিষয়ে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাপরিচালক কামরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ অনেক বেশি। এটি কমানোর জন্য আমরা রেগুলেটরি অথরিটির কাছে অনেক আগে থেকেই আবেদন জানিয়ে আসছি। এবার যখন টিকিটমূল্য যৌক্তিক করতে সরকার আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছে, তখনো আমাদের পক্ষ থেকে এই দাবি জানানো হয়। তাই আমরা আশাবাদী, দেশের এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষ শিগগিরই একটি ইতিবাচক উদ্যোগ নেবে। কারণ হ্যাঙারের ইজারামূল্য কমালে আমাদের পরিচালন ব্যয় কমবে। তখন ভাড়া কিছুটা হলেও কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব চার্জের পাশাপাশি ডলার প্রাইস বৃদ্ধিতে আমাদের বিমানগুলোর তেল খরচসহ সার্বিক খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এতে করেও বিমানের টিকিটের দাম আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে।’
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বেবিচকের এক বোর্ডসভায় হ্যাঙার ভাড়া কমানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় পুনর্নির্ধারণ কমিটি ভাড়া কমিয়ে নতুন ইজারামূল্য প্রস্তাব করেছে, যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। অনুমোদন হলে ইজারামূল্য কমবে।
হ্যাঙারের ইজারামূল্য পুনর্নির্ধারণে গঠিত কমিটির নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রতি বর্গফুট ইজারার ভিত্তিমূল্য হবে ৪০ টাকা এবং ২০২৪ জুলাই থেকে ২০২৫ জুন পর্যন্ত ইজারামূল্য হবে প্রতি বর্গফুট ৪১ টাকা। প্রতিবছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বৃদ্ধির পর ২০২৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত ইজারামূল্য ৪৬ টাকা ৩৯ পয়সা দাঁড়াবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘হ্যাঙারের ইজারামূল্য পুনর্নির্ধারণ প্রস্তাব আমরা বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখানে অনুমোদনের পর এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে, সেখানে অনুমোদন হলে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।’