
পরিবহন খাত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে রাজধানীর বায়ুর গুণগত মান ব্যবস্থাপনা (একিউএম) ও আরামদায়ক গণপরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশের সড়কে ইলেকট্রিক বাস আনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট (বিসিএপি) প্রকল্পের আওতায় এই বাসগুলো সড়কে নামাতে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ডিটিসিএ ভবনে এই প্রকল্প নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় ডিটিসিএ, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়াও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে দেবে ২০০ মিলিয়ন ডলার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ২০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ডিটিসিএ পাবে ১৫০ মিলিয়ন এবং বিআরটিএ পাবে ৫০ মিলিয়ন ডলার। ডিটিসিএ তার অংশে সিটি বাস সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ইলেকট্রিক বাসের প্রবর্তন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও কারিগরি সহায়তা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনগত সংস্কার ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন, বৈদ্যুতিক বাসের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা (ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম) এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কারিগরি সহায়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ প্রকল্পটি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে টেকসই নগর পরিবহনকে উৎসাহিত করতে কাজ করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি নগরে যানজটও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে এ প্রকল্পটি ২০৩০ সালের ৩০ জুন শেষ হবে।
এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হলো, ঢাকা শহরে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বাস পরিচালনা মডেলের মাধ্যমে গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়ন। এই প্রকল্পে সিটি বাস সার্ভিস ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি ২০০-২৫০টি ইলেকট্রিক বাস কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই বাসগুলোর জন্য নতুন ১০টি বাস ডিপো স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে।
ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, ‘ইলেকট্রিক বাসগুলো পরিচালনা করতে নতুন কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে অথবা সরকার নিজস্ব উদ্যোগেও এসব বাস পরিচালনা করতে পারে। বাসগুলো দূরপাল্লায় নাকি স্বল্পপাল্লায় পরিচালনা করা হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি।’
পরিবহন খাত বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. শামছুল হক খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইলেকট্রিক বাস আনার এই প্রকল্পে প্রথমে নজর দিতে হবে অবকাঠামো খাতে। ইলেকট্রিক বাসগুলো কোথায় চার্জ দেওয়া হবে, চার্জিং স্টেশনগুলো কোথায়-কীভাবে নির্মাণ করা হবে- এগুলো পরিকল্পনা করতে হবে। সরকারের গণপরিবহন খাতসংক্রান্ত নানা প্রকল্প পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা কেনাকাটায় যত মনযোগী, রক্ষণাবেক্ষণে নন।’
একটি ইলেকট্রিক বাস তৈরি করতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে, যা ডিজেলচালিত বাসের প্রায় পাঁচ গুণ। অর্থনৈতিক মন্দায় দেশে সবগুলো খাত যখন ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করছে, তখন সরকার কেন বিপুল ব্যয়ে এই ইলেকট্রিক বাস কিনতে যাবে- এমন প্রশ্ন করা হয় অধ্যাপক শামছুল হককে। তিনি বলেন, ‘এই বাসগুলো কিনতে বিপুল ব্যয় হলেও এগুলো পরিচালনায় ব্যয় কিন্তু অনেক কমে যাবে। রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে এই বাসগুলোর আয়ুষ্কালও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে গণপরিবহন খাতের জন্যই সেটি লাভজনক প্রকল্প হতে পারে।’
২০২৩ সালে ‘এক্সিলারেটিং দ্য ট্রানজিশন টু ইলেকট্রিক মোবিলিটি ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় বিআরটিসির বহরে ১০০টি ইলেকট্রিক বাস যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আয় বাড়াতে আন্তর্জাতিক রুটে বরিশাল-কলকাতা, চট্টগ্রাম-কলকাতা, ঢাকা-গ্যাংটক (সিকিম)-দার্জিলিং, ঢাকা-নেপাল বাস সার্ভিস চালুর কথাও ভেবেছিল বিআরটিসি। প্রথমে ভারতীয় লাইন ক্রেডিট (এলওসি) ও পরে কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পে ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছিল। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভারতের ঋণপ্রাপ্তি এখন অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতের স্থলে এখন অন্য একটি ঋণদাতা দেশ খুঁজছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। কোরিয়ান ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া যাবে। আমরা আশা করছি ১০০টি ইলেকট্রিক বাস আমাদের বহরে যুক্ত করতে পারব।’ বাসগুলো দূরপাল্লার নাকি স্বল্পপাল্লার রুটে পরিচালনা করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশের অনেক রুটে বিআরটিসির বাসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। রুট বিবেচনা করে সেখানে ইলেকট্রিক বাস পরিচালনা করা হবে।’