
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এখন সংবিধান সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কারণ ওই অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। কিন্তু এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত জানিয়েছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপি মনে করে, সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। তবে আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দলের বিপক্ষে এমপিরা ভোট দিতে পারবেন না। বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখার ৬ নম্বর দফায়ও একই প্রস্তাব আছে। এসব বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে চায় বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা- এই চারটি বিষয় সংরক্ষিত রেখে বাকি বিষয়গুলোতে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতার প্রস্তাব দিয়েছি। দলের বিপক্ষেও তারা সমালোচনা করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি, এই উপমহাদেশের রাজনীতির যে সংস্কৃতি, সেখানে দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না রাখলে সরকারের স্থিতিশীলতা রাখা কঠিন হবে এবং অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তবে আমরা সময় নিয়ে পর্যায়ক্রমে ভবিষ্যতে উন্নীত হতে পারব।’
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সংবিধানের ৬৭ ও ৭০ অনুচ্ছেদের ফ্লোর ক্রসিং বর্তমানে বন্ধ করা উচিত হবে না। এটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে যুক্ত করা হয়েছিল। এটি আরও দুই মেয়াদ পর্যন্ত রাখতে চান তারা। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার হয়, তাহলে এমপিদের বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে, তখন অনুচ্ছেদ ৭০ পুনর্বিবেচনা করা যাবে।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনে আমরা লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। এখন তারা কোনটা গ্রহণ করবেন বা যোগ-বিয়োগ করবেন, সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলেও সমস্যা, আবার রাখলেও নানা সমস্যা। তাই যুক্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। তাই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলছি না। যা আছে তা থাকবে, কিন্তু ব্যবহার সম্পর্কে কিছু নিয়মনীতি করা যেতে পারে।’
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না। অথবা সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট লিখিত সংস্কার প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে বেশির ভাগ দলই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল বা সংস্কার চেয়েছে। তবে জামায়াত আরও দুই টার্ম সময় নেওয়ার কথা বলেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনের জন্য আমরা ভারতের পার্লামেন্টের একটা নিয়ম অনুসরণ করতে পারি। সেখানে নিয়মটা হলো, দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে মতামত জানাতে চাইলে দলের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের একমত হতে হবে। তার মানে কোনো দলের সদস্যসংখ্যা যদি ৩০ জন হন, তবে তার মধ্যে ১০ জনকে একসঙ্গে দ্বিমত হতে হবে। ভারতে নিয়ম হলো, এই দ্বিমত পোষণ করা সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এই পদ্ধতিটা আমাদের দেশেও চালু করতে হবে। এটা করতে পারলে তখন যাকে-তাকে দলে নিয়ে আসা বন্ধ হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি এর আগে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সরকার গঠন, বাজেট অনুমোদন ও অনাস্থা প্রস্তাব শুধু এই তিনটি ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ৭০ অনুচ্ছেদ বন্ধ হলে সংসদ সদস্যরা কিছুটা স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারবেন। তবে এর সুযোগ নিয়ে সরকারি দলকে ভাঙার চিন্তা করা কিন্তু সহজ হবে না। ধরা যাক, জাতীয় সংসদে একটা সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ১৫১ জন সদস্য লাগবে। এখন তাদের মধ্যে ৫১ জন সদস্য দলের সিদ্ধান্তের বাইরে এসে দ্বিমত পোষণ করবেন, এটা চিন্তা করা কঠিন।’
অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধনের বিষয়ে যা বলছে অন্য দলগুলাে
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার বা সংশোধন চেয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। দলগুলো বলছে, অর্থবিল, বাজেট পাস, অনাস্থা ভোট ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করবেন।
জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনো দল সরকার গঠন করার পর সেই দলের সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়ে বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়গুলো আলাদা করে অনুচ্ছেদ ৭০-এ লিপিবদ্ধ করতে হবে। যেকোনো বিল পাসের ক্ষেত্রে এমপিদের তাদের বিবেক অনুসারে পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দেওয়ার রাইটস থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার পক্ষে। তবে সবার দিক বিবেচনা করে এখন সংশোধন চাইছি। যদি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে তারা যদি অর্থবিলের বিরোধী, সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় তাহলে সংসদে দল টিকিয়ে রাখা কষ্ট হবে। টাকা দিয়ে কেনাবেচা খেলার সুযোগ তৈরি হবে। মূলত এসব কয়েকটি ধারা বাদে বাকিগুলোতে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ নয়, সংবিধানে এই দেশ, জাতি, ইসলাম ও মানবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেসব ধারা রয়েছে তা সংশোধন করা উচিত বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, ’৭২-এর সংবিধান ভারতের চাপানো সংবিধান। এ সংবিধানে ভারতের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ রয়েছে। ভারতের সংবিধানের হুবহু মূলনীতিগুলো সংবিধানে কেন আসবে? ফলে সংবিধানে এই জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় রয়েছে। সেগুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা যেন তাদের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা পান সেই প্রত্যাশাই আমরা করি। ৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বাতিল নয়, কয়েকটি ধারার সংশোধন করা যেতে পারে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সংশোধনের কথা বলেছি। দুই-তিনটি ধারা বাদে বাকি বিষয়ে সংসদ সদস্যদের অপছন্দ হলে বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন এমন বিধানের প্রস্তাব দিয়েছি। এতে সংসদে সবাই স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখতে পারবেন।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের খবরে কাগজকে বলেন, ‘অর্থবিল ও অনাস্থা ভোট বাদে যেকোনো বিষয় সংসদ সদস্যরা যাতে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন সেই সুপারিশ করেছি।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নয়, এটা রিভিউ করা দরকার। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সময়োপযোগী সংশোধন করা জরুরি। হুবহু এক রাখা প্রয়োজন মনে করছি না। তবে সংসদ সদস্যদের অধিকার যেন খর্ব না হয়। কিন্তু আবার কিছু জায়গায় দল ও দেশের নিরাপত্তার বিষয়টাও রাখতে হবে।’
এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ বাদ দিলে দলের ওপর নেতার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। দলের এমপিরা নেতার নির্দেশ মানবেন না। এটাকে হয়তো কিছুটা সংস্কার করার সুযোগ রয়েছে।’