
‘আসসালামু আলাইকুম। বসুন, কী বিষয়ে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি?’ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে ৩টায় ভাটারা থানায় একজন সেবাপ্রত্যাশীর উদ্দেশে এভাবেই কথা বলছিলেন ডিউটি অফিসারের সহযোগী এএসআই মেজবাহ। পানির মিটার চুরিসংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যাওয়া ব্যক্তিকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে আইনি সেবা দিতে দেখা গেছে।
কেবল ভাটারায় নয়, গত দুই দিন রাজধানীর উত্তরা পূর্ব, পল্টন ও রমনা থানা সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের আচরণে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি পাল্টে গেছে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ থানার চোহারা।
গত বছরের ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে ভগ্নদশা হওয়া ভবনগুলোতে লেগেছে আধুনিকায়নের ছোঁয়া। অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো থেকে শুরু করে বসার জায়গাগুলো নতুন করে সাজানো হয়েছে। এসব থানায় এখন পুলিশের আইনি সেবাতেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। থানায় আগত সেবাপ্রত্যাশীদের মন জয়ের জন্যই যেন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা।
ওপরে উল্লিখিত থানাগুলোতে অবস্থানকালে ডিউটি কক্ষে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের আচরণেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। অতীতের সেই রুক্ষ আচরণ এখন দেখা যায়নি, বরং সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করতে দেখা গেছে। অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা ঘটনাস্থলে টিম পাঠানোর বিষয়েও তোড়জোড় দেখা যায়।
আলাপকালে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেন, ‘পুলিশ জনগণের সেবায় নিয়োজিত। ভুক্তভোগীর পাশে থেকে তাকে আইনি সেবা দেওয়াই আমাদের কাজ। সেটির আপ্রাণ চেষ্টা আমরা করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরা আমাদের দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতে চাই। পুলিশ দ্বারা যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নির্যাতন কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সেবা দিতে কাজ করছি। সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শতভাগ কাজ করার চেষ্টা করছি। আসামি ধরতে গেলেও আগে ভালোভাবে তদন্ত করে দেখা হয়।’
উত্তরা পূর্ব থানা
১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ১০ মিনিট। উত্তরা পূর্ব থানা ভবনের প্রবেশ গেটে শফিকুল নামে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভবনে ঢুকতে বাম দিকে ডিউটি অফিসারের কক্ষ। সেখানে বসে কাজ করছিলেন ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুবল ও একজন নারী পুলিশ সদস্য। এদিকে ডিউটি কক্ষে এক ব্যক্তি প্রবেশ করে জানান, তার গাড়ির ট্যাক্স টোকেন হারিয়ে গেছে। এখন এই কাগজটি নতুন করে তুলতে হবে। তাই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে এসেছেন। ডিউটি অফিসার সুবল তার বিষয়টি শুনে বলেন, ‘একটু বসুন, জিডি করে দিচ্ছি।’ এর পরই দ্রুততম সময়ে জিডির প্রক্রিয়া সারতে দেখা যায়।
কাজ শেষে থানা থেকে বের হওয়ার সময় কথা হয় জিডিকারী আলী আজমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডে কোথাও তার আরএভি-৪ মডেলের গাড়ির ট্যাক্স টোকেনের কাগজ খোয়া যায়। এ নিয়ে জিডি করতে এসেছি, এসে বেশ আন্তরিক আচরণ দেখলাম। ভালোই লাগল।’
দুপুর ১টা ২০ মিনিট উত্তরা পূর্ব থানার ডিউটিরত কর্মকর্তারা থানায় আসছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। ঠিক তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন ডিউটি অফিসারের কক্ষে। তিনি বলছিলেন, দ্রুত বিডিআর মার্কেটের পাশে একটি টিম পাঠাতে হবে। সেখানে ঝামেলা শুরু হয়েছে। সেখানে উত্তরা নার্সিং ইনস্টিটিউটে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওসি দ্রুত টিম পাঠাতে বললে খাওয়া বন্ধ রেখেই পুলিশ কর্মকর্তারা ছোটেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশে। ওই সময় থানায় পুলিশ সদস্যদের বেশ তৎপরতা দেখা গেছে।
আলাপকালে থানায় ডিউটিতে থাকা একাধিক পুলিশ সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশ তো এখনো জনমানুষের চোখের বিষের মতো। কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে পুলিশের কাছেই আগে আসে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করে থাকি। আমরা সাধারণ মানুষের আস্থায় যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি, তাদের মন জয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এ প্রসঙ্গে উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামীম আহমেদ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, “স্বাভাবিকভাবে এই থানায় দৈনিক ২০ থেকে ২৫টি সাধারণ ডায়েরি বা অভিযোগ হচ্ছে। উত্তরা বিভাগের অন্যান্য থানা থেকে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা আয়তনে একটু ছোট। তবে আমাদের থানা এলাকায় একটু ‘ভিআইপি’ মানুষের বসবাস বেশি। ঘনবসতি না হওয়ায় এখানে অন্যান্য ঝামেলা কম। কিন্তু আমরা প্রায়ই উটকো ঝামেলা পোহাই।’
ভাটারা থানা
১৩ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে ৩টায় ভাটারা থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা ভবনের বাইরে সড়কে পড়ে ছিল ৫ আগস্ট-পরবর্তী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সেই গাড়িগুলো। থানা ভবনে প্রবেশ করে ডিউটি কক্ষে দেখা যায় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে। ডিউটি ডেস্কে বসে কাজ করছিলেন ডিউটি অফিসার এসআই দিবাকর এবং এএসআই মেজবাহ। এসআই দিবাকর এক ভুক্তভোগীর একটি অভিযোগ লিখছিলেন। অন্যদিকে থানায় এক ভারতীয় নাগরিককের সঙ্গে আলাপ করছিলেন এএসআই মেজবাহ। জুবায়ের আহমেদ নামে ওই ভারতীয় নাগরিক তার পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় এসেছিলেন একটি জিডি করতে। তিনি বাংলা বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। তবে ডিউটি অফিসার তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে তার বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
ভুক্তভোগী ভারতীয় নাগরিক জোবায়ের আহমেদ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ এলাকায় তার বাড়ি। তিনি বাংলাদেশি এক নারীকে বিয়ে করে বর্তমানে বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসায় থাকছেন। তবে তার পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বিপদে পড়েছেন। তার পাসপোর্ট পুনরায় তৈরি করতে তিনি থানায় একটি জিডি করতে এসেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি আগে অনেক সময় থানায় এসেছি। তবে বাংলাদেশ পুলিশ অনেক আন্তরিক। তারা আমার বিষয়টি নিয়েই কাজ করছেন।’
ভারতীয় নাগরিক জুবায়ের আহমেদ ছাড়াও অনেকেই সেবা নিতে এসেছিলেন। এর মধ্যে বারিধারা থেকে একজন এসেছেন তার পানির মিটার চুরি গেছে মর্মে জিডি করতে। জিডির কপি ওয়াসা অফিসে জমা দিলে নতুন মিটার দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন ওই ভুক্তভোগী।
ভাটারা থানার ডিউটি অফিসার দিবাকর জানান, ওই দিন (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪০টি জিডি হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। তবে হুমকি-সংক্রান্ত কোনো জিডি বা অভিযোগ এখনো পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা জনগণকে শতভাগ সেবা দিতে কাজ করছি। কিছুদিন আগেও পুলিশ পুরোপুরি কাজ করতে পারেনি। কিন্তু এখন আমাদের পুলিশ সদস্যরা সব জায়গায় গিয়ে সেবা দিতে পারছেন। ঘটনার খবর পাওয়ামাত্রই স্পটে ফোর্স পাঠানো হচ্ছে।’
পল্টন থানা
১৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টার দিকে রাজধানীর পল্টন থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানা ফটকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য থাকলেও থানা অনেকটাই ফাঁকা। থানা ভবনে ঢুকতেই ডান পাশে ডিউটি অফিসারের কক্ষ। সেখানে বসা ছিলেন এসআই শাহজালাল। পাশে ছিলেন একজন নারী পুলিশ সদস্য। সেখানে জাহিদুল ইসলাম জুয়েল নামে একজন ভুক্তভোগী একটি অভিযোগ দায়েরের জন্য এসেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল- ‘ভিজকম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর’ নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘গত মার্চ মাসে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে মালয়েশিয়া পাঠাতে ছয়জনের জন্য ২৮ লাখ টাকা জমা দিয়েছি। তারা ভিসার কাগজপত্রও দিয়েছে, কিন্তু লোক পাঠাচ্ছে না। টাকা ফেরত চাইলে সেটিও দিচ্ছে না। তারা কোনো যোগাযোগও করছে না। এ জন্য থানায় এসেছি একটি অভিযোগ দেওয়ার জন্য।’
এ সময় ডিউটি অফিসারকে বলতে শোনা যায়, একটি অভিযোগ লিখে জমা দিলেই দ্রুত পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেবেন। ওই সময় অবশ্য থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানে তিনি ছিলেন না। তবে ডিউটি অফিসার জানিয়েছেন ওসি স্যার বাইরে টহল পরিদর্শনে গেছেন।
ডিউটি অফিসার এসআই শাহ জালাল খবরের কাগজকে বলেন, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০টি জিডি দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই হারানোসংক্রান্ত।
রমনা থানা
১৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার দিকে রমনা থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষে ছিলেন এসআই আজিজুল ও নাজমুল। রমনা থানা ডিউটি কক্ষটি একটু ছোট পরিসরে রয়েছে। সেখানেও দেখা গেছে কয়েকজন ভুক্তভোগী সেবা নিচ্ছেন। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল অনেক আন্তরিকতার সঙ্গেই পুলিশ সদস্যরা এ থানায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। অস্বাভাবিক কোনো কিছু এ সময় চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে আলাপ করতে গেলেও ডিউটি অফিসার বা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা আগ্রহ দেখাননি।
সিফাত/