
সরকারের ঋণের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার কমছে। এতে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকঋণের সুদহারও অনেকটাই কমে আসবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা এ মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, প্রথমত- এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়নি, ফলে ঋণের সুদহার বাড়বে না। দ্বিতীয়ত, সরকারের ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও অনেকটাই কমে আসছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকছে। ফলে বেসরকারি খাত প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাবে। বিনিয়োগের দুয়ার আরও সম্প্রসারিত হবে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সম্প্রতি সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে উল্লেখযোগ্য হারে সুদের হার কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়বে। এতদিন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিবিহীনভাবে মুনাফা করেছে ব্যাংকগুলো। এখন সুদের হার কমে যাওয়ায় মুনাফাও কমবে। ফলে তারা এখন ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেশি মুনাফার আশায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ করবে। তবে বিনিয়োগের পরিবর্তে ব্যক্তি খাতে ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থেকেই যাবে। যথাযথভাবে বিনিয়োগ বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা স্ফীত হবে।’
একই বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক কিছু স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগে বেসরকারি খাত কিছুটা চাপ অনুভব করেছে। তবে তার সুফল এখন দেখা যাচ্ছে। মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার না বাড়ানো একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও অনেকটা কমে গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথভাবে তার নীতি পরিপালন করছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটা দিক। এখন গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হলে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী রোজার ঈদের পরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ শুরু করতে পারবেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার যেখানে সর্বোচ্চ প্রায় ১২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল তা এখন ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।
ট্রেজারি বিল ও বন্ড হলো একটি স্বল্পমেয়াদি আর্থিক ঋণপত্র যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার জারি করে। সাধারণত এগুলো এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। এটি একটি নিরাপদ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেও পরিচিত। কারণ এর ওপর সুদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে এবং সরকারের পক্ষে ইস্যু করা হয়। ট্রেজারি বিল ও বন্ড সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি কিনতে পারেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত তারল্য ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ ছাড় হচ্ছে না।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার বেশি ঋণ নেওয়ায় বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বেশির ভাগ সময়েই বেসরকারি খাতে কমেছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরেও একই ধারা বহাল রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তাই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও ব্যাপক হারে কমেছে। এ সময় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৩৪ শতাংশ। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৭ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ ছাড়া, সবশেষ প্রকাশিত জিডিপির তথ্যে দেখা গেছে, প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে চলতি মূল্যে জিডিপির হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদরা সরকারকে ব্যাংকমুখী না হয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যত সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
এই বিষয়ে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি সরকার বেশি ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিনিয়োগ কম হবে, আর বিনিয়োগ কম হলে কর্মসংস্থান কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমন অবস্থায় সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।’
এদিকে বাস্তবতার আলোকে ও অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ মেনে সরকারও খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় অনেক কমে আসছে। সে জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
চলতি অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। সম্প্রতি সেটা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩০ জানুয়ারি শেষে সরকারের মোট ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে সার্বিকভাবে ব্যাংকের আমানত খুব বেশি না বাড়লেও ভালো ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে অনেকে ভালো ব্যাংকে রাখছেন। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে আসছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়ছে। আর এই তারল্য ব্যাংকগুলো ঝুঁকিবিহীন নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এখন সরকারের চাহিদা কিছুটা কমায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাইলেও বেশি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেশি লাভের আশায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করবে ব্যাংকগুলো।
এই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অধিকাংশ ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য আছে। আবার বেসরকারি খাতেও ঋণের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। তাই ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এখন সরকার নিট ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে- খরচ কমাতে চাইছে। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতে চাহিদা বাড়লে ব্যাংকগুলো সেখানেই বিনিয়োগ করবে।