ঢাকা ৫ চৈত্র ১৪৩১, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
English

বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক কমানোর দাবিতে অনড় ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:১০ এএম
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক কমানোর দাবিতে অনড় ব্যবসায়ীরা

ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে ৯টি পণ্য ও সেবায় বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। তবে এখনো বেশির ভাগ পণ্য ও সেবায় তা রয়েই গেছে। ব্যবসায়ীরা বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানালেও আমলে নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ব্যবসায়ীরাও দাবি আদায়ে অনড় রয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে খরচ বেড়েছে অনেক খাতে। ব্যবসায়ীরা করোনার সময়ে ব্যবসা করতে পারেননি। করোনার পর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাবে এখনো আমরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমাদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বাড়তি চাপ সামলাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।’

একই মত জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন হতে দেখছি না। আশা করি এনবিআর বিষয়টি বিবেচনা করবে।’

বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারির পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করেও বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছে। অটোমোবাইল ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামেন। এনবিআরের সামনে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত মাসে (জানুয়ারি) অধ্যাদেশ জারি করে কয়েকটি খাতে পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পরামর্শে কিছু খাতের বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক সমন্বয় করা হয়েছে। আরও অনেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তাৎক্ষিণকভাবে এসব কমানো সম্ভব নয়। অনেক হিসাবের বিষয় আছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এসব বিষয় নিয়ে ভেবে দেখা হবে। নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

গত এক মাসে অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এক জোট হয়ে দেখা করে একই দাবি করেছেন। তবে এসব বৈঠক থেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানো হবে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট, কর ও শুল্কহার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ না পড়ে। ভ্যাট, কর ও শুল্কের ভারে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবেন কীভাবে? বিষয়টি সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। তাই ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভ্যাট, কর ও শুল্কহার ধার্য করা প্রয়োজন।’

তিনি হিসাব কষে বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কিনে প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করি। টমেটো, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্পের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে খরচ বাড়বে। বর্ধিত ভ্যাটের কারণে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ার কারণে অনেকেই এসব পণ্য কিনবেন না। এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ায় ব্যবসা কমিয়ে আনতে হবে। কারখানা বন্ধ হলে অনেক শ্রমিক বেকার হবেন।’

বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে এনবিআরে আবেদন করা হয়েছে। এসব আবেদনে অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ে খরচ বেড়েছে অভিযোগ করে আরোপিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যে যদি ভ্যাট থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যবসা করবেন? এরই মধ্যে আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর জোরালো আবেদন করেছি। কিন্তু আমাদের দাবি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। কবে বাস্তবায়ন করা হবে তার আশ্বাসও পাওয়া যায়নি।’

বর্ধিত ভ্যাট কমানোর দাবিতে এনবিআরে জমা দেওয়া আবেদনে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) থেকে বলা হয়েছে, সংগঠনের প্রায় ৪০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর বাইরেও পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। কাঁচামাল সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতাসহ পরোক্ষভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ খাতে যুক্ত। হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপারশপেও এখন বাংলাদেশে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। এ খাতে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এখন বর্ধিত ভ্যাট আরোপের ফলে এ খাত মুখথুবড়ে পড়বে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারাবে বাংলাদেশ।

বাপার সভাপতি এম এ হাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের ফলে দাম বেড়ে গেলে পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন ভোক্তারা। স্বাভাবিকভাবে কোম্পানিগুলোও কাঁচামাল হিসেবে কৃষিপণ্য সংগ্রহ কমিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। তারা ফসলের ভালো দাম পাবেন না।’

এনবিআরে জমা দেওয়া ব্যবসায়ী সংগঠনের আবেদনে হিসাব কষে দেখানো হয়েছে, ভ্যাটের হার বাড়িয়ে অনেক খাতে ১৫ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। এ হারের সঙ্গে বিভিন্ন ধাপে ভ্যাট যোগ হয়ে শেষ পর্যন্ত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে ভোক্তাকে। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৫-১৬ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের কারণে ব্যবসা ও শিল্পে মুনাফা কমবে। অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়বে। 

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করি না। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। মনে রাখতে হবে, এনবিআর ও ব্যবসাযীরা একে অন্যের সহযোগী, প্রতিপক্ষ না।’ 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের চাপে রেখে অর্থনীতি গতিশীল করা যায় না। বরং ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করে, রাজস্ব ছাড় দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করতে হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’

লাটে উঠেছে নাগরিক সেবা

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০১:১৭ পিএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০১:১৯ পিএম
লাটে উঠেছে নাগরিক সেবা
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রদের পাশাপাশি কাউন্সিলরদের অপসারণ করায় নাগরিক সেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে মেয়র ও কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকেন্দ্রিক সেবা কার্যক্রম লাটে উঠার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনপ্রতিনিধি না থাকায় ঠিকঠাক নাগরিক সেবা মিলছে না। আগামী স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে সমস্যা সমাধানেরও সুযোগ নেই। তাই আমলানির্ভর না হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সারা দেশে নেটওয়ার্ক তৈরি করে নাগরিক সেবা বাড়ানো যেতে পারে।

জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। আর ওয়ার্ড পর্যায়ে ‘ওয়ার্ড সচিব’ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তারা সপ্তাহে দুই দিন ছুটিতে থাকেন। বাকি পাঁচ দিন দুপুরের পর তাদের আর কার্যালয়ে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া নিজ দপ্তরের কাজে তারা মাঝে মধ্যে জেলার বাইরে থাকেন। এতে আগের মতো সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। 

 জন্মসনদ, নাগরিক ও মৃত্যুর নিবন্ধনসহ চারিত্রিক, উত্তরাধিকার সনদ, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর দিতে হয় জনপ্রতিনিধিদের। এ ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে বিচার-সালিশের ক্ষেত্রেও জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখতেন। দেশের রাজনৈতিক পেক্ষাপট পরিবর্তনের পর জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে লাটে উঠেছে নাগরিকসেবা। 
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেই এখন সড়কবাতি নেই। ফলে চুরি-ছিনতাই দৈনিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। গত সোমবার আসাদ গেট থেকে রাতে মিরপুরে বাসায় যাওয়ার সময় ছিনতাইকারী ব্যবসায়ী রাকিবের মোবাইল-মানিব্যাগসহ সব নিয়ে যায়। ভুক্তভোগী ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমনিতে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। তাদের ধরার কোনো উপায় নেই? এখন শহরের রাস্তায় কোথাও কোনো লাইট জ্বলে না। এই সুযোগে চুরি-ডাকাতি তো হবেই। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি ২৭ নং ওয়ার্ড সচিবের কার্যালয়ে কয়েক দিন ধরে ধরনা দিচ্ছেন জাকের আলী। তিনি বলেন, একটি বেসরকারি চাকরির জন্য চারিত্রিক সনদ নিতে আগে কাউন্সিলরের কাছে এলে পাওয়া যেত। এখন এত নিয়ম-কানুন দেখাচ্ছে, এক দিনের কাজ দশ দিন লেগে গেল। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। লোকাল জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কিন্তু স্থানীয় মানুষের সংযোগ থাকে। এই সংযোগটা গ্যাপ হয়ে যাওয়াতে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (প্রশাসন) ও ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ (আইনশৃঙ্খলা) এর ঘাটতি হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে, তাহলে এত দীর্ঘ সময় তো স্থানীয় সরকার অকার্যকর থাকতে পারে না। তাই সরকার যদি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নিয়মে নিয়ে আসতে চায় তাহলে আমলানির্ভর লোকদের যুক্ত না করে বরং উল্টাটা করা উচিত। আমাদের বিভিন্ন এলাকায় যারা যোগ্য এবং সমস্যা ডিল করতে পারবেন- তাদের নিয়োগ করা উচিত। তাহলে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ ফিরে আসবে। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজও কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত। যা এখন ঝুলে আছে।’ 

অতীতের প্রেক্ষাপট টেনে এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, আমাদের উন্নয়ন কাজ সমন্বয়হীন। যখন রাজনৈতিক সরকার ছিল তখনও বলেছি- উন্নয়ন সমন্বয়হীন হয়ই লাভের গুড় ভাগাভাগি করে খাওয়ার জন্য। সমন্বয় হলে রাস্তা একবার কাটলেই হয়, আর ১০টা সংস্থা ১০ বার কাটলে দশবার ভাগাভাগি হবে। এসবের জন্য বার্ষিক পরিকল্পনার পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নাগরিকসেবা মিলছে ঢিমেতালে। জন্ম-মৃত্যু, ওয়ারিশ আর চারিত্রিক সনদ পেতে সময় লাগছে অনেক বেশি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ। রাস্তা, অলিগলি ও ফ্লাইওভারে পড়ে থাকছে আবর্জনা; দায়িত্ব নিয়ে যা অপসারণের কেউ নেই। ফলে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। 

ঢাকা উত্তর সিটিতে ৫৪টি আর দক্ষিণে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। জনসেবায় দুই মেয়রের পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ছিল। এর সঙ্গে উত্তরে ১৮ জন আর দক্ষিণে ২৫ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ছিলেন। নাগরিকসেবার বিষয়গুলো তারাই দেখতেন। সিটি করপোরেশনের ৭ থেকে ৮টি ওয়ার্ড মিলে একটি আঞ্চলিক নির্বাহী অফিস গঠন করা হয়েছে। উত্তরে ৫৪টি ওয়ার্ডের জন্য ১০ জন, দক্ষিণে ওয়ার্ড ৭৫টি হলেও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ১০ জন দিয়ে চলছে সিটি করপোরেশনের কাজ। অর্থাৎ ৭-৮টি ওয়ার্ডের জনসেবার বিষয়গুলো দেখছেন সিটি করপোরেশনের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা)। 

জনপ্রতিনিধি না থাকায় জনগণের ভোগান্তির বিষয় নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে গতকাল কয়েক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। সচিবকে মেসেজ দেওয়া হলেও রিপ্লাই আসেনি।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকলেও ৫ আগস্টের পর থেকে সব কাউন্সিলর আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন হিসেবে খ্যাত নগরের ওয়ার্ড অফিসগুলোতে সীমাহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাসিন্দারা। নগরের হালিশহরের নূর জাহান বেগমের স্বামী গেল জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাংকের টাকা উত্তোলন ও জমিজমা সংক্রান্ত প্রয়োজনে স্বামীর ওয়ারিশান সনদ পাওয়াটা তার জন্য জরুরি। কিন্তু ২ মাস ধরে তিনি ওয়ার্ড অফিসে ঘুরেও সেটি পাচ্ছেন না। একইভাবে পুরো শহরের ৪১টি ওয়ার্ডের একই চিত্র। কোথাও স্মার্ট টিসিবি কার্ড, কোথাও জন্মনিবন্ধন, কোথাও ওয়ারিশান সনদ পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। 

ওয়ার্ডগুলোতে কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া না হলেও চসিকের কর্মকর্তাদের এসব দায়িত্ব পালনে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তারা দাপ্তরিক দায়িত্বের বাইরে ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে জনগণের সেবা পাওয়া আরও দুরূহ হয়ে উঠেছে।

সিলেটে: সিলেট বিভাগে স্থানীয় সরকার বিভাগে জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ থেমে আছে। কিছু কিছু এলাকায় উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও কাউন্সিলর না থাকার কারণে অপরিকল্পিতভাবে কাজ করছেন ঠিকাদাররা। যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। 

বেশির ভাগ মানুষ এখনো জানেন না কাউন্সিলরের পরিবর্তে দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তারা কোথায় বসেন। বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রিট লাইট নেই। অনেক রাস্তা ভাঙা। মশক নিধনে নেই জোরালো ভূমিকা। এলাকায় কাউন্সিলর না থাকার কারণে অভিযোগ দেওয়ার জায়গাও পান না নগরবাসী।

ময়মনসিংহ: নগরীতে যেসব সড়কের সংস্কারকাজ চলছিল, সেসব সড়ক খুঁড়ে রাখা অবস্থায় পালিয়েছেন ঠিকাদাররা। ফলে জনভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। 

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে একজন কর্মকর্তা একাধিক দায়িত্ব পালন করায় সাধারণ মানুষ যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। যেকোনো সনদ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি না থাকায় মশা নিধন কর্মসূচি সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী।

ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে সিটির আওতাধীন শতকোটি টাকার ছয়টি প্যাকেজের সড়ক ও ড্রেন নির্মাণকাজ বাতিল করা হয়েছে। এতে আসন্ন বর্ষায় জলাবদ্ধতাসহ ব্যাপক ভোগান্তির শঙ্কায় রয়েছেন নগরবাসী।

বরিশাল: বরিশাল সিটির ৩০টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে তেমন একটা দেখা করতে পারছেন না। ফ্যামিলি কার্ড থেকে স্মার্টকার্ডে রূপান্তরের সময়ে ৯০ হাজার কার্ড থেকে প্রায় ৬০ জাহার কার্ড বাতিল হয়েছিল। এ নিয়ে বাসিন্দারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। স্থানীয়রা জানান, নগরীতে বর্তমানে শতকোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে কাজের গতি অত্যন্ত ধীর। ফলে বর্ষা শুরুর আগে এসব রাস্তাঘাট ড্রেনের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। 

এদিকে বাড়ি নির্মাণের জন্য করপোরেশনে জমা দেওয়া বাড়ির প্ল্যান অনুমোদন পাচ্ছে না প্রার্থীরা। ফলে ১ হাজার ২০০-এর বেশি বাড়ির প্ল্যান আটকে আছে। তা নিয়ে বাড়ির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কয়েক দফা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন।

খুলনা: খুলনা মহানগরীতেও একই অবস্থা। খুলনার বটিয়াঘাটার জলমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিধান চন্দ্র রায় আত্মগোপনে থাকায় নাগরিকদের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিক সনদপত্র, ওয়ারিশনামার মতো জরুরি সেবা পেতে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। 

ভুক্তভোগী সুলতানা শারমীন জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য নাগরিক সনদপত্রের প্রয়োজন। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদে তিন দিন এসেও সনদপত্র হাতে পাননি এখনো। সিটি করপোরেশন এলাকায় মেয়র না থাকায় রাস্তাঘাটের সংস্কার কাজ থমকে গেছে ও মশক নিধন প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে।

রংপুর: রংপুরের ৩৩টি ওয়ার্ডে নিয়োজিত প্রশাসকরা নিজের দাপ্তরিক কাজের চাপে রংপুর সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ২৩ নং ওয়ার্ডের রংপুর ক্যান্টপাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী শোয়াইব হক শীবতি বলেন, দীর্ঘদিন ঘোরাঘুরির পর ন্যাশনাল আইডি পেয়েছি। এত বেশি ভোগান্তি, কেউ যেন এই ফাঁদে পা না দেন। 

সিটি করপোরেশনের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধক মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতিদিন ২০০ সনদ দেওয়ার কথা থাকলেও সার্ভেয়ার ও প্রশাসক নিয়মিত না থাকায় জনগণের সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। 

বিভাগীয় কমিশনার ও রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধি হলে আলাদা কথা, কিন্তু আমাদের অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। তারপরও চেষ্টা করা হচ্ছে কাজগুলো দ্রুত করার।

রাজশাহী: রাজশাহী মহানগরীতে সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী, নাগরিকদের সব সেবা অব্যাহত রাখতে মেয়রের স্থলে বিভাগীয় কমিশনার ও কাউন্সিলরদের স্থলে সরকারি দপ্তরের ১৮ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিজ দপ্তরের কাজের বাইরে অতিরিক্ত এই দায়িত্ব কেউ ঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। ফলে বিভিন্ন সেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, দায়িত্ব পাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব রয়েছে। তারা সপ্তাহে দুই দিন ছুটিতে থাকেন। বাকি পাঁচ দিন বিকেল হতে না হতে কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না। এ ছাড়া নিজ দপ্তরের কাজে তারা মাঝে মধ্যে জেলার বাইরে থাকেন। এতে আগের মতো সেবা এখন পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজশাহীতে শীত কমায় বেড়েছে মশার উপদ্রব। রমজান মাস চলায় মশার তীব্র উৎপাতের কারণে ইফতারি ও সাহরির সময় মানুষ নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়ছেন। এতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

প্রতিবেদনটি তৈরি করতে খবরের কাগজের বিভাগীয় প্রতিনিধিরা তথ্য পাঠিয়ে সাহায্য করেছেন।

পুলিশ-জনপ্রশাসন-সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে অনেক আপত্তি

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৭ এএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৬ এএম
পুলিশ-জনপ্রশাসন-সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে অনেক আপত্তি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের কারণে নির্বাচনের আগে সংস্কারের পক্ষে ছিল জনমতও। সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সরকারের একাধিক কমিশন এরই মধ্যে রিপোর্টও জমা দিয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক সুপারিশ নিয়ে অংশীজনরা আপত্তি জানাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এত আপত্তির মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে বা বাস্তবায়ন হবে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংস্কার কার্যক্রম অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আপত্তি আসুক আর যাই আসুক, সংস্কার হতেই হবে। সংস্কার হতে হবে বিশেষ করে এই চারটি খাতে। এই সংস্কার যদি না হয়, তাহলে দেশ টিকতে পারবে না। দেশ এখন যে অবস্থায় আছে, সংস্কার ছাড়া ভালোভাবে পরিচালনা করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।’ 

তিনি বলেন, ‘সংস্কার না করে নির্বাচনের মধ্যে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। কারণ একটা নির্বাচিত সরকার আসে, তাদের তো ক্ষমতার ক্ষেত্র একটু কমে যায়। তাদের অনেককে খুশি রাখতে হয়। অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। এই সরকার তো একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে, তারা অনেক কিছু করতে পারে। যেটা নির্বাচিত সরকার পারবে না। তাদের বাধা-নিষেধ আসবে না। নির্বাচিত সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এই সরকারের আমলে সংস্কার হয়েই তারপর নির্বাচন করা উচিত। প্রত্যেকটা জায়গায় হাত দিতে এবং সংস্কার করতে হবে।’ 

সবার বক্তব্যকে আমলে নিতে হবে জানিয়ে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান খবরের কাগজকে বলেন, সংস্কার এমন একটা জিনিস, যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। সংস্কার তো কোনো বিপ্লব না। সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া যায় না। অংশীজন, রাজনৈতিক দল ও সরকার সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেখানে ঐকমত্য হবে, সেই সংস্কারগুলো করে ফেলতে হবে। বাকি সংস্কারগুলো সংসদ নির্বাচন হলে তখন জনগণের একটা সরকার আসবে, তাদের মাধ্যমে করা হবে। 

পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ১৩টি বিষয়ের ওপর। এ ছাড়া ২২টি আইনের পরিমার্জনের কথাও বলা হয়েছে। তবে অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের চাওয়া নিরপেক্ষ কমিশন বা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। কিন্তু এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকা বা সরাসরি প্রস্তাব না রাখায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এই কমিশনের গঠন, কার্যপদ্ধতি, আইনিভিত্তি নিয়ে আরও পর্যালোচনার মত দেয় কমিশন। বিষয়টিসহ আরও একাধিক বিষয় নিয়ে কথা বলছেন পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও এসব বিষয় সামনে আসে।

অংশীজনদের আপত্তির মধ্যে সংস্কারকাজ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা উচিত। এটা তো কারও বিরুদ্ধে না। আমরা তো সবাই বলি, পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক। পুলিশ স্বাধীন কমিশনের অধীনে কাজ করবে, এটা সরকার একটা কমিশন গঠন করে দিল। কমিশনের ভদ্রলোকেরা (সদস্যরা) ধরি মাছ না ছুঁই পানি, কিছুই করল না।’ 

পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ ব্যক্তির মতে, এখানে দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। দ্বিতীয়ত, যেসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে এগুলোর নিষ্পত্তি করা। 

তিনি বলেন, ‘পুলিশ তো নিজ থেকে বলছে, আমি যদি ভুল করি আমার শাস্তি হওয়া উচিত। স্বাধীন শক্তিশালী ওয়াচ ডগ থাকবে। কিন্তু এগুলো তো হচ্ছে না। পুলিশকে তো যখন যে দল আসবে তাদের কথামতো চলতে হচ্ছে। সংস্কার এক সরকার করল আরেক সরকার এসে বাতিল করে দেবে। তাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। একটা কমিশন হবে সেখানে সরকারি লোক থাকবে, বিরোধী দলের লোক থাকবে, নিরপেক্ষ লোক থাকবে, সিভিল সোসাইটি থাকবে, সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সেখানে আলাপ-আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। কেউ বাড়াবাড়ি করতে পারবে না।’

অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারদের মধ্যে ব্যাপক আপত্তি রয়েছে। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা কমিশন প্রধানের পদত্যাগেরও দাবি জানান। উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ক্যাডার থেকে নিয়োগ, পদোন্নতিতে পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার হিসেবে না রাখাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষুব্ধ ক্যাডার কর্মকর্তারা। বিসিএস পরিসংখ্যান ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংস্কার কমিশনও ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কিছু অংশ নিয়ে ইতিবাচক মতামত এলেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ অন্য বিষয়গুলোতে রয়েছে আপত্তি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের কথা বলছে। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকেও ভিন্ন অবস্থান রয়েছে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে।

আর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে আপত্তির কথা লিখিতভাবে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এনআইডি কার্যক্রমের দায়িত্ব, নির্বাচনি সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কমিশন গঠনসহ অন্তত ১০টি বিষয় তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইসির বক্তব্য অনুযায়ী, এসব বাস্তবায়ন হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। আগামী ২০ মার্চ আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে সরকার। সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মতামত গ্রহণ করছে। এখনো বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জমা দেয়নি, সময় চেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হবে জুলাই সনদ। বিশ্লেষকদের মতে, সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে।

খুলনায় চরমপন্থিদের কিলিং, বাড়ছে উদ্বেগ

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪২ এএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৫ এএম
খুলনায় চরমপন্থিদের কিলিং, বাড়ছে উদ্বেগ
প্রতীকী ছবি

খুলনায় চরমপন্থি সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন-পাল্টাখুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। চরমপন্থিদের একের পর এক টার্গেট কিলিং স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ১৯৯৪ সালে চরমপন্থি নেতা টাইগার খোকন দিয়ে শুরু হয় এ কিলিং মিশন।

সর্বশেষ গত শনিবার রাতে স্থানীয় ক্যাডার বড় শাহীন এ টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন। 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ সালের দিকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি চরমপন্থি সংগঠন গড়ে তোলেন খুলনা নগরীর দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা গাজী কামরুল ইসলাম। ওই সময় দৌলতপুরে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আকতারুজ্জামান খোকন ওরফে টাইগার খোকন পাল্টা আরেকটি চরমপন্থি সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৯৪ সালে দুই সংগঠনের দ্বন্দ্বে খুন হন টাইগার খোকন। এর পর থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে দ্বিধাবিভক্তি, সন্দেহ ও খুন-পাল্টাখুনের ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর দৌলতপুরে খুন হন চরমপন্থি গাজী কামরুলের অনুসারী শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহিদ। ১৯৯৬ সালে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে গাজী কামরুল আত্মসমর্পণ করেন। এরপর পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে শীর্ষ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হলে অন্যরা আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও দুটি গ্রুপের মধ্যে হত্যা-পাল্টাহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে।

এদিকে ৫ আগস্টের পর দৌলতপুর এলাকায় আবারও চরমপন্থিরা সংগঠিত হতে থাকে। সেই সঙ্গে মাথা চাড়া দেয় তাদের পুরোনো বিভেদ। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর এলাকায় ফিরে আসেন শীর্ষ চরমপন্থি টাইগার খোকনের সহযোগী শাহীনুল হক শাহীন ওরফে বড় শাহীন। অন্যদিকে কারামুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরে আসেন দুই চরমপন্থি নেতা রিফুজি মঈন ও আসলাম ওরফে ট্যারা আসলাম। তাদের সহযোগীরা এলাকায় ফিরে রীতিমতো ত্ৰাস সৃষ্টি করে। 

সর্বশেষ গত শনিবার রাতে চরমপন্থি ক্যাডার বড় শাহীনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি চরমপন্থি নেতা শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহিদ হত্যা মামলার ২০ আসামির একজন। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু। তিনিও হুজি শহিদ হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। এ ছাড়া ২০২২ সালের ৩০ জুন মুজগুন্নী এলাকায় জুলকার নাঈম মুন্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও একই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। 

আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর তথ্যমতে, শুরুর দিকে গাজী কামরুল ইসলামের অনুসারী ছিলেন গোলাম রব্বানী টিপু ও হুজি শহিদ। দৌলতপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী টাইগার খোকনের অন্যতম ক্যাডার ছিলেন বড় শাহীন। ১৯৯৬ সালে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে গাজী কামরুল আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ১৭ বছর কারাভোগের পর ২০১৩ সালে তিনি জামিনে মুক্ত হন। গাজী কামরুলের অনুসারী হুজি শহিদ হত্যা মামলার প্রতিশোধ নিতে ভাড়াটে খুনিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। হুজি শহিদ হত্যার ২০ আসামির মধ্যে এ পর্যন্ত জুলকার নাঈম মুন্না, গোলাম রব্বানী টিপু ও বড় শাহীন টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন। এর মধ্যে গোলাম রব্বানী টিপু হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিরা স্বীকার করেন যে তারা হুজি শহীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা খুন করেছেন। তবে গত শনিবার রাতে শাহীন হত্যার ঘটনায় পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। 

এ বিষয়ে খুলনা থানার ওসি সানোয়ার হোসেন মাসুম বলেন, শাহীনের মাথায় গুলির দুটি চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।

বড় শাহীন হত্যায় গ্রেপ্তার নেই

খুলনায় চরমপন্থি নেতা শেখ শাহীনুল হক শাহীন ওরফে বড় শাহীনকে হত্যার ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। নিহতের মা রাহিমা বেগম খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা করবেন বলে জানা গেছে। তবে ছেলের মৃত্যুর সংবাদে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় মামলার এজাহার দায়েরে বিলম্ব হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।

খুলনা সদর থানা ওসি সানোয়ার হোসেন মাসুম বলেন, কারা এবং কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তবে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশ কাজ করছে। তিনি বলেন, রাতের বেলায় পরিচিত কেউ তাকে ওই স্থানে ডেকে এনে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করে। বড় শাহীন টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন বলে মনে করা হচ্ছে। এ হত্যার ঘটনাটি প্রতিশোধমূলক কিনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

পাইকারিতে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে, প্রভাব নেই খুচরায়

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:১৮ এএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:২৯ এএম
পাইকারিতে ভোজ্যতেলের  দাম কমেছে, প্রভাব নেই খুচরায়
চট্টগ্রামে নির্ধারিত দরে মিলছে না খোলা সয়াবিন। ছবিটি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় একটি খুচরা দোকান থেকে তোলা। ছবি: খবরের কাগজ

বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও দুই সপ্তাহের ব্যবধান খোলা সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি দাম কমেছে ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। পর্যাপ্ত আমদানি, জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের কঠোর উদ্যোগ এবং দফায় দফায় অভিযানের পরও বাড়তি অর্থ আদায়ের স্বভাব বদলাতে পারেননি খুচরা ব্যবসায়ীরা।

নগরীর বড় পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে দুই সপ্তাহ আগে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৬০ টাকা ৩৭ পয়সায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৫১ টাকা ৯২ পয়সা। একই সময়ে পাম অয়েলের দাম ৩ টাকা ৩৮ পয়সা কমে ১৩৬ টাকা ৪৯ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘মিলমালিকরা ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়িয়েছে। বর্তমানে খাতুনগঞ্জেও পণ্যটির সরবরাহ আগের তুলনায় ভালো। তাই দামও নিম্নমুখী।’

এদিকে বিভিন্ন কোম্পানি বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ বাড়িয়েছে। মেঘনা গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (ট্রেডিং) নাছির উদ্দিন বলেন, ‘যথাসময়ে তেল খালাস করে পরিশোধন করা হচ্ছে। অন্য সময়ের তুলনায় এবার ভোজ্যতেল আমদানিও বেশি হয়েছে। বর্তমানে সয়াবিন তেলের সংকট নেই। সরবরাহ অনেক বেশি। আমরা যথাসময়ে তেল বাজারজাত করছি।’

এদিকে পাইকারিতে দাম কমার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ ছাড়াও নগরের হালিশহর, আগ্রাবাদ, নিউ মার্কেট, নাসিরাবাদ, দুই নম্বর গেট, চকবাজার ও কাজীর দেউড়ি এলাকার বিভিন্ন মুদি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব দোকানে এক, দুই ও পাঁচ লিটার ওজনের বোতলজাত সয়াবিন তেল দেখা গেছে। তবে দুই ও পাঁচ লিটার ওজনের তেলের সরবরাহ বেশি দেখা গেছে। প্রতি লিটার তেল ১৭৫ টাকা বিক্রির কথা থাকলেও এলাকাভেদে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার তেল মিলছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়। অপরদিকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। যদিও গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার জন্য প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন।

এর আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত এক সভায় জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জানান, রাষ্ট্রের শক্তি বেশি না ব্যবসায়ীদের শক্তি, তা তিনি দেখতে চান। এরপর চসিক মেয়র ও জেলা প্রশাসক নিজেরাই কিছুদিন বাজার তদারকি করেন। কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের শক্তিতেই অটল আছেন। দফায় দফায় অভিযানেও মিলছে না সফলতা।

নগরের নাসিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মো. আফজাল হোসেন বলেন, দুই লিটার সয়াবিন তেল ৩৮০ টাকা দিয়ে কিনেছি। দোকানি ৩০ টাকা বেশি নিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে উল্টো বলেন, ‘৩৮০ টাকায় কিনলে কিনেন, না কিনলে যান।’

বাজার ঘুরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। নগরের হালিশহর এলাকার আল মদিনা স্টোরের মালিক মো. নাছির দাবি করেন, ‘আগে খোলা সয়াবিন ১৯০-১৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম তো কমে এসেছে।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অভিযানে গেলেই অল্প কিছু অর্থ জরিমানা এবং সতর্ক করা হয়। এতে করে তো কখনো সফলতা আসবে না, অসাধু ব্যবসায়ীদের টনক নড়বে না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

ডিসেম্বরে ভোট নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:০৫ এএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:২৩ এএম
ডিসেম্বরে ভোট নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দলটি মনে করছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকারসংশ্লিষ্টদের মতামত এক জায়গায় স্থির থাকছে না। তারা ডিসেম্বর, মার্চ ও জুন- এই তিন সময়কে সামনে এনে একেকজন একেক সময় একেক কথা বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও তার বক্তব্যে কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলছেন না। ফলে ডিসেম্বরে আদৌ ভোট হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।

সবশেষ গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাতে খুব বেশি সময় নেই, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এর দুই দিন আগেই গত শুক্রবার ঢাকায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ এখানে ছয় মাস নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সামনে রেখে তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে বিএনপিতে নতুন করে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ দুই বক্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন বিএনপি নেতারা। ডিসেম্বর বা জুনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করারও চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদের কেউ কেউ মনে করেন। তারা বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন করতে কত দিন সময় লাগবে সরকারের সে বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা উচিত, তা না হলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও জনগণের দূরত্ব বাড়তে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টা তার কথা রাখবেন এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড।’ অর্থাৎ যদি কোনো জাজমেন্ট দিতে দেরি হয়, তাহলে বুঝতে হবে জজ সঠিক রায় দেবেন না। রায় যদি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন তাহলে বুঝতে হবে, এটা সঠিক রায়। আর যদি রায় না দেন তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যদি সঠিক সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশ ও জনগণ আরও সংকট পড়বে। জনগণের কপালে দুর্ভোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তার সরকার। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জানিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়ে কমিশনের কাজ এগোচ্ছে। সবশেষ গত ১০ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর সময়সীমা পার করতে চায় না ইসি। অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে চায় ইসি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রধান উপদেষ্টার একেক সময়ে একেক বক্তব্যে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

পাশাপাশি ওই বক্তব্যের পরে রাজনৈতিক মহলেও নতুন করে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে, নির্বাচন আদৌ এ বছরের ডিসেম্বরে হবে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবকে কোনো কথা বলা মানে এর তাৎপর্য অনেক বেশি। তারা সন্দেহ করছেন, ডিসেম্বরে ভোট না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ থাকতে পারে। তাই নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ স্পষ্ট করতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন ঠেলতে ঠেলতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। আর পরিস্থিতি এমন হলে আগামী দেড় থেকে দুই বছরে অনেক ঘটনায় দেশের রাজনীতির মাঠে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে।

জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা উপহার পায়। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ দল ভোট বর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু একবারই বিশেষ কারণে জুনে ভোট হয়েছে। জুন-জুলাই মাসে বর্ষা ও গরমের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির কম।

তাই জুন-জুলাইয়ে আগামী নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, গরম ও বর্ষার মধ্যে ভোটাররা ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করেন না। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা থাকে। তাই শীতের সময়টিতে নির্বাচনের জন্য সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব দিক বিবেচনা করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে তা পরবর্তী বছরের অক্টোবরের আগে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকে।

নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব দৃশ্যমান রয়েছে। এ প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর মনোভাব আবার সরকারের কাছাকাছি। এ কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকার ও ছাত্রদের মধ্যে সখ্য দেখছে বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কারণেই বিএনপিতে সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে, সরকার আদৌ নির্বাচন দেবে কি না? এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে চাপে রাখতে এপ্রিলে মাঠের আন্দোলনে যেতে পারে বিএনপি।

জানা গেছে, ঈদের পর এই ইস্যুতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগামী জুন-জুলাই নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময়। সংস্কার-সংস্কার করে নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়োজন নেই। কিছু সংস্কার হয়েছে, বাকিগুলো করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক।’ তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ডিসেম্বরের কথা বলেছেন, আবার বেশি সংস্কারের জন্য পরের বছরের জুনের কথা বলেছেন। তবে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ নির্বাচন চায়। যদি কারও কথায় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, তাহলে দেশের ক্ষতি হবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার আসবে না। আবার যদি এই সরকারের মধ্যে ফ্যাসিস্ট আচরণ জন্ম নেয় তাহলে জনগণ আশাহত হয়ে পড়বে। সে জন্য দ্রুত নির্বাচন দেওয়া জরুরি বলে মনে করি।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে কোন বছরের কোন মাসের কত তারিখে নির্বাচন হবে- তার রোডম্যাপ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো দেয়নি। ফলে সরকারের নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি সরকার ক্ষমতা ছাড়লে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই বিতর্ক করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিলম্ব করলে সরকারের জন্য বিপজ্জনক। দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংশয়ের মূলে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং এনসিপি নেতাদের নানা কথাবার্তা। বিএনপি মনে করছে, সরকার ও ছাত্ররা নির্বাচন হোক এটা চাইছেন না। বিশেষ করে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারসহ কয়েকজন উপদেষ্টা নির্বাচনের বিপক্ষে। ছাত্রনেতারা ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। এ জন্য তারা বৃহৎ সংস্কারের কথা তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন।