
চট্টগ্রামে গোলাগুলি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা কাজ করছে। তবে নাগরিক সমাজের অভিমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে কখনো কখনো পুলিশ নিজেই হুমকি পাচ্ছে, হামলার শিকার হচ্ছে।
পুরো জেলায় যেন আইন ভাঙার উৎসব চলছে! চট্টগ্রাম মহানগর এবং বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও অস্ত্রের কারবার, বালু মহাল দখল, মাটি ও গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন কারণে অপরাধ বাড়ছে।
সাজ্জাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি গত ২৮ জানুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে নগরীর বায়েজিদ থানার ওসি আরিফুর রহমানকে পেটানোর হুমকি দেন, গালাগাল করেন। এ ঘটনায় ওসি নিজে থানায় জিডি করেন। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সাজ্জাদকে ধরতে পুরষ্কার ঘোষণা করে।
এ ঘটনার পর গত এক মাসে চট্টগ্রামে পুলিশ চারবার আক্রান্ত হয়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চান্দগাঁও কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় জড়িত দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গুনিয়ায় বেড়াতে এসে পুলিশের সাবেক এক উপপরিদর্শক ছিনতাইয়ের শিকার হন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অন্যদিকে, একইদিন ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানাধীন বারেক বিল্ডিং মোড়ে ছুরিকাহত হন দুই পুলিশ সদস্য। সর্বশেষ আলোচিত ঘটনা ঘটে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। পতেঙ্গা থানার এক পুলিশ সদস্যকে ভুয়া পুলিশ উল্লেখ করে মব সৃষ্টি করে হেনস্তা করা হয়।
নগরীর খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লা মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়িতে ছিনতাই, ডাকাতি হচ্ছে। এ ছাড়া গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নগরীর এ কে খান এলাকায় ছিনতাইকারীরা ভয় দেখিয়ে ট্রাক থেকে কয়েক বস্তা পেঁয়াজ ছিনিয়ে নেয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আমাদের বিষয়টি জানিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে তো ব্যবসা করা দায় হয়ে পড়বে।’
নগরীর আকবর শাহ এলাকার বাসিন্দা ও পরিবেশ কর্মী সফিকুল ইসলাম মনে করেন, ‘এলাকার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। ছিনতাই, হুমকি দিয়ে টাকা আদায়, সরকারি প্লট দখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এখানে হচ্ছে না। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো একটু স্বচ্ছল পরিবার দেখলেই ফ্যাসিবাদের দোসর বলে রাতে হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। আর পাহাড় কাটা তো এখন আরো সহজ কাজ।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে জেলা থানাগুলোতেও। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি-দখল নিয়ে রিদোয়ান ও রোকন মেম্বার গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ সময় সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বন্ধ করে দেওয়া হয় সিএনজি অটোরিকশাসহ সব ধরণের যানচলাচল। পরদিন তারা ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়। সেখানকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা দিবসের কর্মসূচি বাতিল করা হয়।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাউজানে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে গত সাড়ে ছয় মাসে সংঘর্ষ, হামলা ও গোলাগুলির অন্তত ৪০টি ঘটনা ঘটেছে। ১৫ নভেম্বর গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়। হানাহানিতে লিপ্ত দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তবে দুজনেরই দাবি, তারা সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর এবারই প্রথম পুলিশ-প্রশাসন আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত একটা ভীতি এবং আতঙ্কজনক অবস্থা বিরাজ করছে। আবার তাদের ভেতরে একটা ক্ষোভ রয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে আগে যে আন্তরিকতা ছিল সেটা আদৌ তাদের আছে কি না দেখতে হবে।’
সিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) মাহমুদা আকতার বলেন, ‘অপরাধ রোধ করার জন্য পুলিশের অভিযান চলছে। অনেক অপরাধী গ্রেপ্তার আছে। ছিনতাইকারি, ডাকাতসহ সব ধরনের আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রতিদিন অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশ সবসময় তৎপর আছে।’
চট্টগ্রামের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, ‘জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কাজ করছে। রাউজানের বিষয়ে তারা বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। আশা করছেন এর সুফল জনগণ পাবেন।’