
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদ পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই হাইকমান্ডের। খুব শিগগির দলের কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ফলে এসব শূন্য পদে যোগ্য নেতাদের পদায়নও হচ্ছে না। তবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দলের বর্ধিত সভার পর অনেকে ভেবেছিলেন এবার হয়তো কেন্দ্রীয় কমিটির শতাধিক শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় প্রকৃত যোগ্য নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু তাও থমকে আছে বলে জানা গেছে।
দলটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দলের বর্ধিত সভা হয়েছে। মূলত এটি দলের ছায়া কাউন্সিল। তাই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিংবা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশেষ ক্ষমতাবলে এসব শূন্য পদে পদায়ন করা জরুরি। তাদের দাবি, পুরো কেন্দ্রীয় কমিটি রিভিউ করে একসঙ্গে সব পদ পূরণ করলে দল আরও শক্তিশালী হবে। নির্বাচনেও নতুন উদ্যমে দল মাঠে নামবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, দলে বহু যোগ্য নেতাই রয়েছেন। আগামী দিনে দল তাদের চিন্তা করতে পারে। বর্তমানে ১১ জন সদস্য দিয়ে স্থায়ী কমিটি চলছে। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দলে যখন যেটা করার দরকার, তখন সেটা পূরণ করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, শূন্য পদ পূরণের এখতিয়ার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের তিনি মূল্যায়ন করবেন। তবে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।
৯ বছর আগে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর কাউন্সিল করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। সেই অনুযায়ী ছয় বছর আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে না ফেরা পর্যন্ত দলের সপ্তম কাউন্সিল হওয়ার সম্ভবনাও কম। এই সময়ের মধ্যে দলের অনেক নেতা মারা গেছেন, অনেকে দল ত্যাগ করেছেন, অনেকে স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসরে গেছেন। আবার অনেক কেন্দ্রীয় নেতা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। অনেকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির শতাধিক পদ এখনো শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির ৩টি, ভাইস চেয়ারম্যান ১৫টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৯টি পদ শূন্য রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর কয়েকটি পদে পদায়ন করা হয়েছে।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ১৯ জন। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। তারা হলেন তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ এবং এম কে আনোয়ার। ২০১৮ সাল থেকেই গুরুতর অসুস্থ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। সেই থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রয়েছেন। এ ছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও তার পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করেনি বিএনপি। স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে গত বছরের ১৬ আগস্ট দুজন ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে পদায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে তিনটি স্থায়ী কমিটির পদ শূন্য রয়েছে। এই তিন পদে আসার আলোচনায় রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন (কায়কোবাদ), আবদুল আউয়াল মিন্টু, আবদুস সালাম পিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। এবার প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও আইনজীবী এই তিন ক্যাটাগরিতেও স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণ করা হতে পারে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির ৩টি শূন্য পদসহ অন্যান্য পদ পূরণ করা প্রয়োজন। তবে তাদের নিয়োগ দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরও অনেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন না। আবার সম্প্রতি অনেককে মূল্যায়ন করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ, যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে দক্ষতা দেখিয়েছেন এমন নবীন-প্রবীণ নেতাদের আগামীতে তাদের যোগ্য পদে পদায়ন করা হবে।
এবার ভাইস চেয়ারম্যান পদেও পদায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত তরিকুল ইসলামের সহধর্মিণী নার্গিস বেগমকে। এর আগে গত বছরের ২০ আগস্ট সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনিকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদায়ন করা হয়। এরপরও ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের পদের মধ্যে ১৫টি পদ ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে দুজনকে স্থায়ী কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। ১০ জন মারা গেছেন, একজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং দুজন পদত্যাগ করেছেন। মারা যাওয়া ১০ জন হলেন বিচারপতি টি এইচ খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, অধ্যাপক এম এ মান্নান, আবদুল মান্নান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউছুফ, অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ও ব্যারিস্টার মো. আমিনুল হক। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান এম মোর্শেদ খান ও মোসাদ্দেক আলী ফালু দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে বিএনপির সাবেক এই দুই ভাইস চেয়ারম্যান আবারও দলে ফেরার চেষ্টা করছেন। তারা বিভিন্ন লবিং-তদবির চালাচ্ছেন। শওকত মাহমুদকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থ রয়েছেন কয়েকজন ভাইস চেয়ারম্যান। এরা হলেন আলহাজ অ্যাডভোকেট হারুন আল রশিদ, বেগম রাবেয়া চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান।
সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক হাজি আমিনুর রশীদ ইয়াসিন ও ড. জিয়াউদ্দীন হায়দার। এরপর ৮২ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির মধ্যেও আরও ৯টি পদ এখনো শূন্য রয়েছে। মারা যাওয়া ৯ জন উপদেষ্টা হলেন হারুনার রশীদ খান মুন্নু, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান পটল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, জাফরুল হাসান, অধ্যাপক ড. শাহিদা রফিক, রোজী কবির, এম এ হক, অ্যাডভোকেট কামরুল মনির। এ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের পদ স্থগিত রয়েছে।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির ৫০২ সদস্যদের মধ্যেও কয়েকজন মারা গেছেন। কয়েকজনকে বহিষ্কার আর কয়েকজন স্বেচ্ছায়ও পদত্যাগ করেছেন। আবার কয়েকজনকে পদোন্নতি দিয়ে শূন্য পদ পূরণ করা হলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনো শতাধিক পদ শূন্য। তবে এসব শূন্য পদ কবে পূরণ হবে, তা নিশ্চিত নয়। তা ছাড়া বয়সের কারণেও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন কিংবা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিশেষ ক্ষমতাবলে এসব পদে পদায়ন করা সম্ভব। বর্তমানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এক জায়গায় আছেন। সুতরাং শূন্য পদে কাউকে পদায়ন করা বা বড় কোনো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত তারাই নিতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যসহ কয়েকটি শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে।’