ঢাকা ১১ বৈশাখ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

সংস্কার, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমর্থন জানিয়ে গেলেন গুতেরেস

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৭:১০ এএম
আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:১০ এএম
সংস্কার, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমর্থন জানিয়ে গেলেন গুতেরেস
চার দিনের সফর শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রবিবার ঢাকা ত্যাগ করেন। ছবি: পিআইডি

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ঢাকা সফরের সময় অন্তর্বর্তী সরকার ও সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি ব্যাপক সমর্থন দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। ফলে এই ইস্যুটি নতুন করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামনে এসেছে। এর ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আগামীতে আরও অগ্রগতি হবে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।

কূটনীতিকদের মতে, জাতিসংঘ মহাসচিব বর্তমান সরকারের সংস্কার কাজগুলোকে সমর্থনের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যও চেয়েছেন। কোনো সংলাপের প্রয়োজন হলে তাতেও সহায়তা দিতে চেয়েছেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তাসহ অন্যান্য মৌলিক সহযোগিতা পূরণে জাতিসংঘকে এই মুহূর্তে পাশে পাওয়াটা ঢাকার জন্য খুবই দরকার ছিল।

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই সফরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা করার বিষয়ে বারবার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়েও তিনি রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে সংলাপে সহায়তাও দিতে চেয়েছেন, যা সরকারের জন্য ভালো হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থায়ন এবং প্রত্যাবাসনে তিনি যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটা কতটা বাস্তবায়ন হবে তা পরে বোঝা যাবে। কারণ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মহাসচিব যতই আশ্বাস দিক, তা বাস্তবায়ন করতে দাতা দেশগুলোর সহায়তা লাগবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা অর্থায়নের অর্ধেকের বেশি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে জাতিসংঘকে। জাতিসংঘ ততক্ষণই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগ নিতে পারবে, যতক্ষণ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা চাইবেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়ার সম্মতি লাগবে। এর আগেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে এই দুটি দেশই নিরাপত্তা কাউন্সিলে বাধা দিয়েছিল।’

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান জানান, এই সফরটি বিভিন্নভাবে ইতিবাচক বলা যায়। কারণ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতসহ বিভিন্ন সংকটে রোহিঙ্গা ইস্যুটি চাপা পড়ে গিয়েছেল। তার এই সফরে এ ইস্যুটি ফের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব পাবে। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকট ও কূটনৈতিক স্থবিরতার কারণে এতদিন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি। এখানে মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ বলা মানেই রোহিঙ্গা ইস্যুটিতে পুনরায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে।’ রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গত ৭ মাস বিভিন্ন বিষয়ে চাপে ছিল। মহাসচিবের এই সফরে সরকারের সংস্কার উদ্যোগ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ সরকারের প্রতি এই বিশ্ব সংস্থার সমর্থন ও সহায়তা বাড়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা সরকারের মনোবল বৃদ্ধিতে কাজে আসবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরটি এমন একসময় হলো, যখন বিশ্বে পরিবর্তন ঘটছে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমেছে। এ জন্য রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্থিরতা বাড়বে। এই সময়ে সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন দেখতে হবে, রোহিঙ্গা অর্থায়নে জাতিসংঘ মহাসচিব কতটা কাজ করতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা অর্থায়ন বাড়ানোর সম্ভাব্য দিকগুলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানালে ফলাফল ভালো হতো। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকাররকে সমর্থনের পাশাপাশি জাতিসংঘ চেয়েছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেন হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে।’

চার দিনের সফর শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রবিবার (১৬ মার্চ) সকালে ঢাকা ত্যাগ করেন। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং রোহিঙ্গা সংকটবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। যাওয়ার আগে জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং বিদায়ী শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

কর্মকর্তা নিয়োগে বয়সের জটিলতা, সমাধান খুঁজছে ঢাবি

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৮ এএম
কর্মকর্তা নিয়োগে বয়সের জটিলতা, সমাধান খুঁজছে ঢাবি

দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গেল বছরের ১৮ নভেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩২ বছর করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিতসহ চাকরির সব পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০-এর স্থলে ৩২ বছর হওয়ার কথা। সরকারের এমন প্রজ্ঞাপনের পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা নিয়োগের তিনটি বিজ্ঞপ্তিতে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর রাখা হয়। সিন্ডিকেট সভার আগে বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রকাশ করায় এমন জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স নিয়ে যত নিয়মই থাকুক না কেন, সরকারের জারি করা সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন প্রাধান্য পাবে। সেক্ষেত্রে বয়স যদি ৩০ থাকে সেক্ষত্রে ৩২ প্রতিস্থাপিত হবে।

বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সমাধানের পথ খুঁজছে ঢাবি প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তি তিনটি হলো- ৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত আইন উপদেষ্টার অফিসের সেকশন অফিসার পদে একটি শূন্য পদ ও এস্টেট অফিসে জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার পদে একটি শূন্য পদ এবং ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত কোষাধ্যক্ষের দপ্তরের সেকশন অফিসার পদে একটি শূন্য পদ। আর সরকার বয়স বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৮ নভেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের দপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৩০-ঊর্ধ্ব অনেকে এসব পদে আবেদন করেছেন। এদের এখন বাছাইতে বাদ দিতে গেলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা সমাধান খুঁজছেন। এক্ষেত্রে সরকারের প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিস্থাপনের বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। সেক্ষেত্রে যারা আবেদন করেছেন তাদের ভাইভা কার্ড দেওয়া যেতে পারে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টার অফিসে সেকশন অফিসার পদে এক আবেদনকারী জানান, সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৩২ পর্যন্ত যাদের বয়স তারা বিবেচিত হবেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম না মানার কারণে যদি তাদের পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেওয়া না হয় তাহলে তারা হাইকোর্টে রিট করবেন। সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনের ২ নম্বর ধারায় অধ্যাদেশের প্রাধান্যে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, আদেশ, নির্দেশ বা আইনগত দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই অধ্যাদেশের বিধানাবলি প্রাধান্য পাইবে।’ আর ৩(গ)-এ বলা হয়, ‘‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যানশিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহের চাকরির যেসব পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ‘৩০ (ত্রিশ)’ বা ‘অনূর্ধ্ব ৩২ (বত্রিশ) বছর’ উল্লেখ রহিয়াছে, সর্বত্র উক্ত বয়সসীমা ৩২ (বত্রিশ) বছর’ প্রতিস্থাপিত হইবে।’’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ খবরের কাগজকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তটি আসার পর সেটি আমরা সিন্ডিকেটে নিয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে সে সিদ্ধান্তের আলোকে নবম গ্রেডের যেসব সার্কুলার হয়েছে সেগুলো ৩২-ই করা হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি, সিন্ডিকেটের সেই সিদ্ধান্তের আগে একটি মাত্র বিজ্ঞপ্তি সেটি ৩০ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বয়সসীমা ৩২ বছর সেটিই সব সার্কুলারে রয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ নিয়ে সিন্ডিকেটে আলোচনা হয়েছে। তা ছাড়া এগুলো তো বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন। যখন সরকারের নীতি-নির্ধারণের পর্যায় থেকে এমন পরিবর্তনগুলো আসে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাঠামো রয়েছে তার মধ্য থেকে ধাপে ধাপে সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করে থাকি। স্বাভাবিকভাবে যেই আবেদনগুলো অনগোয়িং রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন হবে কি না সেটি আমরা চিন্তা করে দেখব।

আইএমএফের কিস্তি পেতে চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৫ এএম
আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৭ এএম
আইএমএফের কিস্তি পেতে চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সরকার। ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করা, রাজস্ব আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি না কমা এবং ব্যাংক খাতের আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া- এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে বাংলাদেশ এখন আইএমএফের যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়ার আশা করছে, তা বড় অঙ্কের না হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইএমএফের ঋণ স্বাভাবিকভাবেই চলমান রয়েছে, বিশ্বের কাছে এই বার্তা দিতে পারাটাই এখন বড় বিষয়। যদি তাতে কোনো রকম বিঘ্ন ঘটে, তাহলে বিশ্বব্যাংকসহ বাকি যে ঋণদাতা সংস্থাগুলো আছে, তারাও বাংলাদেশকে ঋণ দিতে অনীহা দেখাবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সম্প্রতি আইএমএফের যে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছে, সেখানে তারা জুনে আগামী দুটি কিস্তি ছাড় হবে- এমন আশ্বাস দেয়নি। এ-বিষয়ক কোনো চুক্তিও হয়নি। আবার এটাও বলেনি যে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। তারা বলেছেন, আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ এখানে এটা পরিষ্কার যে আইএমএফের দেওয়া সব শর্ত এখনো পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে পরবর্তী দুটি কিস্তি প্রাপ্তিতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। 

বর্তমানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দুজনই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন সম্মেলনে উপস্থিত আছেন। এই বৈঠক গত সোমবার শুরু হয়ে চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। সেখানে আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, আইএমএফের ঋণের কিস্তির পরিমাণ খুবি বেশি না। তবে এটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বাজেট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নগদ অর্থের প্রয়োজন আছে। বাজেট সহায়তা লাগবেই। এই সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি। এখন আইএমএফের কিস্তি যদি কোনো কারণে বাতিল হয়, তাহলে তারাও সরে যেতে পারে। এ জন্যই এই মুহূর্তে আইএমএফের কিস্তি পাওয়াটা খুবই দরকার। 

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মূলত দুটি জায়গায় আইএমএফের বড় আপত্তি রয়েছে। প্রথমত, ডলারের দর বাজারভিত্তিক করা আর দ্বিতীয়ত, রাজস্ব বাড়ানো। এই দুই জায়গাতেই হয়তো সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরেকটু নমনীয় হওয়া দরকার। এই দর বাজারভিত্তিক করতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক দিন ধরেই বলে আসছে এখনো সময় হয়নি। তাহলে সঠিক সময় কখন আসবে! এখন তো ডলারের সরবরাহ বেশ ভালো। আমদানিও কম হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও ডলারের দামও কমে আসছে। এখন যদি সময় না হয়, তাহলে আর কখন হবে? আর রাজস্বের ক্ষেত্রে আইএমএফকে আরও একটু বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। কারণ আইএমএফ যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিচ্ছে, সেটা আসলে অর্জনযোগ্য না। 

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিশ্চয়তা আছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, “আমরা তো ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী। অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর দুজনই এখন সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। আইএমএফের বৈঠকের ফাঁকে এ বিষয়ে একটা ‘উচ্চপর্যায়ের বৈঠক’ হবে।” 

তবে অনিশ্চয়তার বিষয়টি তিনি একেবারে উড়িয়ে দেননি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনিশ্চয়তা তো কিছু রয়েই গেছে। যে কারণে স্টাফ লেভেলের বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারা বলেছে, এ বিষয়ে আরও আলোচনা দরকার।’

এর আগে আলোচনা শেষে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তির পর ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার এবং ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করে আইএমএফ। গত বছরের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

তবে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, বিদেশি মুদ্রার নিট সঞ্চিতি বা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্থার ঠিক করে দেওয়ার শর্ত পরিপালন না করায় ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় করেনি আইএমএফ।

ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ডিসেম্বরে ঢাকা সফর করে আইএমএফ মিশন। সে সময় ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ চলতি বছরের ‘ফেব্রুয়ারি-মার্চের’ মধ্যে হাতে পাওয়ার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সে সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পর্ষদের অনুমোদন পেলে বাড়তি অর্থ মিলিয়ে চতুর্থ কিস্তিতে মোট ১১০ কোটি ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। কথা ছিল, তৃতীয় কিস্তির অর্থের ব্যবহার পর্যালোচনা শেষ করে ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির পর্ষদ সভার পর ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চতুর্থ কিস্তির ৬৪ দশমিক ৫ কোটি ডলার ছাড় করবে সংস্থাটি। চতুর্থ কিস্তিতে অর্থ পেতে শর্ত ছিল চারটি। সেগুলো হলো অর্থনীতির বহির্চাপ সামাল দিতে রাজস্ব আদায় জোরদার করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে নীতিমালার বাস্তবায়ন। এর মধ্যে বিনিময় হার ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে আইএমএফ সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

ফেব্রুয়ারিতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, দুটি শর্ত পূরণ না হওয়ায় আইএমএফের বিলম্বিত ঋণ প্যাকেজের চতুর্থ কিস্তির সঙ্গে পঞ্চম কিস্তির অর্থ জুন মাসে একসঙ্গে ছাড় হতে পারে। 

কিন্তু গত ৬ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশের অর্থনীতির নানা বিষয় এবং আইএমএফের দেওয়া শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। এতে নেতৃত্ব দেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী দুই কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দেয়নি আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, এ বিষয়ে আলোচনা আরও চলবে। 

আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের পাশাপাশি বিনিময় হারও স্থিতিশীল। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে। জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহের নিম্নতম হারের কথা উল্লেখ করে আইএমএফ করব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেয়। সংস্থাটি বলেছে, করনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকা উচিত। এ ছাড়া করছাড় কমাতে হবে, করনীতিকে সহজ করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির টেকসই পথ খুঁজে বের করতে হবে। রাজস্ব আয় সংগ্রহে এমন একটি সমন্বিত কৌশলপত্র করতে হবে, যাতে এ রাজস্ব দিয়ে সরকার সামাজিক খাতে ভালো ব্যয় করতে পারে এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।

আইএমএফের এই মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ( সিপিডি)। রাজস্ব বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী দিনে সরকার যদি উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পায় তাহলে ভর্তুকি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে না।

সাত ইস্যুতে বিশেষ নজর সিআইডির

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০২ এএম
আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১১ এএম
সাত ইস্যুতে বিশেষ নজর সিআইডির
অপরাধ তদন্ত বিভাগ

মানব ও অর্থ পাচার মামলাসহ অন্তত ছয়-সাতটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশেষায়িত এই ইউনিটের সদর দপ্তরে আয়োজিত ক্রাইম কনফারেন্স তথা অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এসব নির্দেশনা দেন সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি গাজী জসিম উদ্দিন। 

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গত রবি ও সোমবার দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ওই পর্যালোচনা সভায় সিআইডিপ্রধান ছাড়াও ইউনিটটির ১৩ জন ডিআইজি (বিভাগীয় প্রধান), সিআইডির সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও সদর দপ্তরের সব শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত ওই ক্রাইম কনফারেন্সে বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে কড়া নির্দেশনা দেন সিআইডিপ্রধান গাজী জসিম উদ্দিন।

বিশেষ ওই ইস্যুগুলোর মধ্যে- অর্থ পাচারসংক্রান্ত (মানি লন্ডারিং) মামলা বা অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা, মানব পাচার রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম ও তদন্ত পরিচালনা, হত্যা মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করা, দীর্ঘদিন ধরে তদন্তাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি বা তদন্ত প্রতিবেদন জমা, মামলার গভীরে যাওয়া ও সঠিকভাবে তদন্ত করা, নিয়মিত ঘটনাস্থল (পিও) পরিদর্শন ও যথাযথভাবে আলামত সংরক্ষণ করা এবং সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম ও তদন্ত আরও জোরদার করার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেন সিআইডিপ্রধান। এর মধ্যে অর্থ ও মানব পাচার এবং হত্যা মামলার তদন্তে বাড়তি গুরুত্ব দিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে গতকাল বুধবার সিআইডির পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) জসীম উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘মালিবাগের সদর দপ্তরে গত রবি ও সোমবার সিআইডির ত্রৈমাসিক ক্রাইম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিআইডির প্রায় সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন।’

সিআইডির পদস্থ অপর একাধিক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, দুই দিনব্যাপী ওই অপরাধ পর্যালোচনা সভায় মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিআইডিপ্রধানসহ ঊর্ধ্বতনরা। পাশাপাশি সিআইডির কাজের বিশাল ব্যাপ্তি ও বিপুলসংখ্যক মামলা অনুসারে দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তার চরম সংকট নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় সিআইডির চট্টগ্রাম বিভাগের অপরাধ চিত্র ও মামলার তদন্ত নিয়ে বিশেষ আলোকপাত করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বলা হয়, ওই বিভাগের জন্য সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ২০ জনের মতো। যাদের প্রত্যেকের ওপর গড়ে ৭০টির বেশি মামলার তদন্তভার রয়েছে। ফলে একেকজনের ওপর এতগুলো মামলার তদন্তের চাপে সার্বিক তদন্ত কার্যক্রমই স্থবির হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে ওই সভায়।
সভায় উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে মানব পাচারের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধ ও কৌশল দুটোই বেড়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। মানি লন্ডারিং আইনে অর্থ পাচারের শতাধিক মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ নিয়েও ওই অপরাধ পর্যালোচনা সভায় আলোচনা হয়। এতে তদন্ত ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানসম্পন্ন তদন্ত কর্মকর্তার অভাবের বিষয়টি উঠে আসে। এই সংকট দূর করার জন্য আলোচনা করেন অপরাধ পর্যালোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা।

ভোল পাল্টে তিনি এখন বৈষম্যবিরোধী নেতা

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৩ এএম
আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩১ এএম
ভোল পাল্টে তিনি এখন বৈষম্যবিরোধী নেতা
ফকির মো. মহিউদ্দীন

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী রেলওয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ফকির মো. মহিউদ্দীন এখন আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, খোলস পাল্টে তিনি এখন হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ফোরামের নেতা। সাবেক দুই রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সেই সুবাদে তিনি রেলওয়ের লাভজনক পদে নিয়োগ পান। সাবেক দুই মন্ত্রীর প্রভাবে তিনি ছিলেন রেলের খালাসি নিয়োগ কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির আশীর্বাদপুষ্ট। বিগত সরকারের সময়ে তিনি ছিলেন ২০ লোকোমোটিভ ও ১৫০ মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ প্রকল্পের পরিচালকও।

গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরই ভোল পাল্টে ফকির মো. মহিউদ্দীন গঠন করেন রেলের বৈষম্যবিরোধী ফোরাম। রাতারাতি হয়ে যান এই ফোরামের মুখ্য সমন্বয়ক। সরকার পরিবর্তনের পর ‘খোলস পাল্টে’ পদোন্নতির মাধ্যমে রেলের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) হন। বিগত সরকারের সময়ে ‘বৈষম্যের শিকার’, এমন মিথ্যা প্রচার চালিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতেই চতুর্থ গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন রেলের ২০তম বিসিএস (তৃতীয় গ্রেড) ব্যাচের কর্মকর্তা ফকির মহিউদ্দিন। শুধু তা-ই নয়, পদোন্নতি পেয়েই তিনি তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপকর্ম বাড়িয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে।  

অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আমলে দুই মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির আশীর্বাদে কেনাকাটায় অনিয়ম, বদলি বাণিজ্য, মালপত্র না কিনে বিল পরিশোধ, ঠিকাদারের পরিবর্তে নিজেই ব্যবসা করেছেন ফকির মো. মহিউদ্দীন। রেলে কেনাকাটায় ‘ভ্যারিয়েশন’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং কোটি টাকা ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন করার অভিযোগ এসেছে মহিউদ্দীনের নামে। এছাড়া অনুমোদনহীন এয়ার ব্রেক কেনার নামে তিনি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফকির মো. মহিউদ্দীনের নামে এসব অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা হয়েছে। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে অনুসন্ধানে নেমেছেন দুদক কর্মকর্তারা। 

অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই কয়েকজন ছাত্র সমন্বয়ককে ভুল বুঝিয়ে রেলওয়ের প্রধান ভবনে শোডাউন করেন ফকির মহিউদ্দিন। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই বিগত সরকারের সময়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) নির্বাচনে সভাপতি পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেওয়ার সেই ছবি এখনো বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রয়েছে। 

সম্প্রতি রেলের বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক অডিট প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিলের (ইডিসিএফ) মাধ্যমে রেলের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে ২০টি লোকোমোটিভ ও ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে প্রকল্পের বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে একই প্রকল্পের আওতায় অতিরিক্ত ৩৭টি কোচ সংগ্রহ করে সরকার। এই ৩৭টি কোচ কেনার ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ না করে প্রকল্পের সমুদয় টাকা চরম অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। 

বিদেশ থেকে মালপত্র বা যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে নিজে লাভবান হওয়ার জন্য ফকির মহিউদ্দীন অতিরিক্ত ৩৭টি কোচ সংগ্রহের ক্ষেত্রে নির্দেশনা অমান্য করেন। চুক্তিতে ৩৭টি কোচের এয়ার ব্রেকের জন্য উন্নতমানের যন্ত্রাংশ জার্মানি থেকে আমদানি ও ফিটিংসের কথা বলা হলেও অবৈধ আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তিনি হাঙ্গেরি থেকে নিম্নমানের এয়ার ব্রেকের যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করেছেন। 

বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির প্ররোচনায় ট্রেন ধোয়ার জন্য ঢাকা ও রাজশাহীতে দুটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করা হয় প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ চাকরি থেকে অবসরে গেলে রেলমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির প্রভাবে এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ফকির মো. মহিউদ্দীন। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ও রাজশাহীতে দুটি ট্রেন (রেল) ওয়াশিং মেশিন স্থাপন করা হয়। অভিযোগ আছে, এই মেশিন কেনা ও সরবরাহের জন্য নির্বাচন করা হয় সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরীর আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানকে।
 
কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রকল্পের আওতায় অধিক দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে চুক্তিতে না থাকলেও ভ্যারিয়েশনের নামে লোপাট করেছেন অতিরিক্ত ৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। 

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত মূল চুক্তিপত্রের ‘বিশেষ শর্ত’ অংশের ক্লজ নম্বর (জিসিসি ১৫.২)-তে উল্লেখ আছে, ‘মূল্য সমন্বয় প্রযোজ্য হবে না’। একই চুক্তিপত্রের চুক্তির সাধারণ শর্ত অংশের ক্লজ নম্বর, জিওসি ১৫.২-তে বলা হয়েছে, চুক্তির অধীনে সরবরাহ করা পণ্য এবং সংশ্লিষ্ট পরিষেবার জন্য সরবরাহকারীর দেওয়া দরের উল্লিখিত মূল্য থেকে ভিন্ন হবে না। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী মূল্য সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই।

এ ছাড়া মূল দরপত্র দলিলে বিডিং ফর্মের নোট ১-এ উল্লেখ আছে, মূল্য উদ্ধৃতি স্থির হবে। অভিযোগ আছে, এর পরও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে দরপত্রে উদ্বৃত্ত মূল্যের চেয়ে শতকরা ২২ দশমিক ৭৭ ভাগ বেশি উল্লেখ করে বিল অব কোয়ান্টিটি (বিওকিউ) দাখিল করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের সাবেক পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ তার নোটে লেখেন, ‘এই ভ্যারিয়েশন প্রস্তাবের (বিল) মাধ্যমে মূল্য সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই।’ তবে অভিযোগে জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অতিরিক্ত ৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতির সিন্ডিকেটকে লুটপাটে সহযোগিতা করেন ফকির মো. মহিউদ্দীন। 

ইতোমধ্যে অবশ্য রেলপথ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনা তদন্তে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. জিয়াউল হককে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু কমিটি গঠন নিয়েই এবার অভিযোগ উঠেছে, অভিযুক্ত ফকির মো. মহিউদ্দীনকে সুবিধা দিতেই তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলসচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানান, এ বিষয়ে কাজ চলছে। কমিটি কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘ওখানে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। তবে তারা কাজ করছেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ওয়াশিং প্ল্যান্ট পরিদর্শনের জন্য তদন্ত কমিটি রাজশাহীতে যাবে।’

জানা গেছে ফকির মো. মহিউদ্দীন ২০০১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী যন্ত্র-প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। ২৫ বছরের কর্মজীবনে অর্ধেক সময় অর্থাৎ গত সরকারের আমলে প্রায় ১২ বছর যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের সবচেয়ে লাভজনক পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময় তিনি সৈয়দপুরে সহকারী কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ); বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো) পাকশী, লালমনিরহাট ও চট্টগ্রাম; কর্ম ব্যবস্থাপক (নির্মাণ) পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম; বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (কারখানা) পাহারতলী, চট্টগ্রাম; প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ও প্রকল্প পরিচালক, রেলভবন; প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) চট্টগ্রাম; প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ও প্রকল্প পরিচালক, রেলভবন ও যুগ্ম মহাপরিচালক পদের মতো লাভজনক পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, এই পদগুলো মেকানিক্যাল বিভাগের সবচেয়ে লাভজনক পদ। এই পদের মাধ্যমে মেকানিক্যাল বিভাগের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, সরবরাহ, ইঞ্জিন মেরামত, যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ দরপত্র ও অন্য ব্যয় নির্বাহের অর্থ বরাদ্দ, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি বা পদায়ন ও প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) এবং ২০ লোকোমোটিভ ও ১৫০ মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ প্রকল্পের পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দীন খবরের কাগজকে খালাসি নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, এটা একেবারেই মিথ্যা অভিযোগ এবং একটি অপপ্রচার। ভ্যারিয়েশনের নামে অর্থ লোপাট অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে এই মহাব্যবস্থাপক বলেন, এ প্রকল্পের প্রথম প্রকল্প পরিচালক হারুন-অর-রশিদ। উনি ভ্যারিয়েশন করার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তিনি সংশোধিত (রিভাইস) নকশা অনুযায়ী কাজটি করিয়েছেন। এতে নকশার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের অন্য আনুষঙ্গিক বিষয় যুক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে ভ্যারিয়েশন সংক্রান্ত সরকারের নিয়ম-নীতিমালার আওতায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে। তা ছাড়া ভ্যারিয়েশনের টাকা দেওয়ার একক কোনো ক্ষমতা প্রকল্প পরিচালকের নেই। এসব প্রক্রিয়া যথাযথ নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ অনুসরণ না করে অর্থ নয়ছয় করার অভিযোগ প্রসঙ্গে ফকির মো. মহিউদ্দীন বলেন, যেসব বগির মালপত্র সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়েছে, সেই ৩৫টি বগি তো এখনো দেশেই আসেনি। তা হলে এখানে অর্থ নয়ছয় করা হয়েছে কীভাবে। এই অভিযোগও সত্য নয় বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক। 

ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক কোনো কালেই ছিলেন না এমন দাবি করে ফকির মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রয়োজনে আমার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

লাভজনক পদে পদায়ন নেওয়ার অভিযোগে প্রসঙ্গে রেলের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকার আমাকে যোগ্য মনে করে নিয়োগ দিয়েছে। আমি শুধু আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরের পক্ষে পাল্লা ভারী, ১০ দল চায় জুন পর্যন্ত টানতে

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০০ এএম
আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ পিএম
ডিসেম্বরের পক্ষে পাল্লা ভারী, ১০ দল চায় জুন পর্যন্ত টানতে
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

এ বছরের ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় বিএনপি। দলটির এই দাবির সঙ্গে একমত জাতীয় পার্টি ও বাম ঘরানার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মোট ৪৭টি দল।

অন্যদিকে ভোটের মাঠে বিএনপির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ১০টি দল ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে নয়। তারা ডিসেম্বর থেকে সময়সীমা জুন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষের পাল্লাই ভারী। যদিও এই ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে একধরনের অস্থিরতা চলছে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বাইরে চারটি দল সংস্কারের পরই নির্বাচন চায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া আলোচিত এই চারটি দল হলো- তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। তবে এই দলগুলোর তৎপরতা প্রায় নেই বললেই চলে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজকে নির্বাচনব্যবস্থা ধসে পড়েছে। এই নির্বাচনব্যবস্থা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ঠিক করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচন ডিসেম্বরে না হলেও জুনের মধ্যে হবে- তিনি এই কথাটা বলে সবাইকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। তবে আমি আশা করছি, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই সরকার ও নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণ ও নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন আমরা সেই সংস্কারটুকু চাই।’

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা দাবি করে আসছেন, নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম সংস্কারকাজ শেষ করতে আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের বেশি সময় লাগার কথা নয়। অনেক সংস্কার এই সরকার করতে পারবে না, সেগুলো নির্বাচিত সরকার এসে করবে।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে মিত্রদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি। এখন পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দল ও জোটের সঙ্গে ঐকমত্য পৌঁছেছে। এর বাইরে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের পক্ষে বুধবার (২৩ এপ্রিল) অবস্থান স্পস্ট করেছে সিপিবি ও বাসদ। এর আগে গত রবিবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে চা-চক্রে এই দুই দলের নেতারা একই মত দেন। 
সূত্রমতে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে বাম-ডানসহ সব রাজনৈতিক দলকে এক মঞ্চে আনতে তাদের সঙ্গেও বৈঠক করবে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় এবার জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবে দলটি। সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সরকারকে বার্তা দেবে দলটি।

ডিসেম্বরে সম্মত নয় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি

বিএনপির দাবি করা ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে না জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি। তারা বলছে, সরকার ঘোষিত নির্বাচনের ডেটলাইন এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন মাসের হলেও তাদের আপত্তি নেই। তবে একতরফা ভোট যাতে না হয় সে জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছে তারা। পাশাপাশি ডিসেম্বরেই ভোট দিতে হবে- সরকারকে এমন চাপ দিতে রাজি নয় এই দল তিনটি।

যদিও সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠকের পর জামায়াত বিএনপির দাবি করা সময়ের কাছাকাছি অবস্থান ব্যক্ত করেছিল। ডা. শফিকুর রহমান তখন জানিয়েছিলেন, রমজানের আগেই, অর্থাৎ আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চান তারা। কিন্তু এখন আবার নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার ও সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি- এই তিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে জামায়াত। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে আবারও দলটি একধরনের দ্বিমত প্রকাশ করেছে। যদিও দলটি এখনো তাদের নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক ফিরে পায়নি। আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলা ঝুলে আছে। নিবন্ধন ফিরে পেতে আইনি জটিলতা বাড়তে পারে, সে জন্য দলটি নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে চাপ দিতেও রাজি নয় বলে আলোচনা আছে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে, সরকারকে চাপ দিয়ে এটা আমরা বলব না। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চেয়েছি। অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে হলে ভালো হবে। কারণ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রোজা হবে এবং জুনে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।’

এদিকে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান পুনর্লিখন ও জুলাই সনদ তৈরির পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় এনসিপি। এসব শর্ত পূরণ হলেই দলটি নির্বাচন অংশ নেবে। যদিও এনসিপি এখনো রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায়নি। দলটি নিবন্ধনের সময়সীমা তিন মাস বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই সনদ ও সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। এরপর নির্বাচন ডিসেম্বরে হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা সরকারকে ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে এমন কথা আমরা বলব না।’

রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়ে চাপ তৈরি করতে রাজি নয়। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হলেই তারা খুশি। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা বলে আসছি, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। এই হিসাবে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হলে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এর আগেই মৌলিক বিষয়গুলোর সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে হবে।’

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আলাদাভাবে চলতে পারে। সরকার আলাদা টাইমফ্রেম করে টার্গেট নিয়ে এগোলে ডিসেম্বরের সঙ্গে এক-দুই মাস এদিক-সেদিক করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তবে সব দলের ঐকমত্য লাগবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে, এটা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর।’

তৃণমূল বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার, দলগুলোর সংস্কার, রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণের মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার হওয়া জরুরি।

এছাড়া, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে।

ডিসেম্বরে ভোটের পক্ষে

বিএনপির মতোই ডিসেম্বরে ভোট আয়োজনের পক্ষে অনড় যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৪টি রাজনৈতিক দল। এগুলো হলো- লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ দল, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও গণফোরাম। এর বাইরে ১২টি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে ভোট চায়। দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি, সমমনা ইসলামপন্থি চার দল, সিপিবি ও বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট, আমার বাংলাদেশও (এবি) চলতি বছরেই নির্বাচন চায়।

১২-দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা দেখে সব দলই তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়। ডিসেম্বরে ভোট দিলে সরকারের জন্যই ভালো হবে।’

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে তিনটি নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিতে পারেননি। তাই দ্রুত নির্বাচন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি মনে করি, ডিসেম্বর কেন, চাইলে আরও দুই মাস আগে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব।’

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, অনির্বাচিত সরকারের বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা ঠিক হবে না। গণ-অভ্যুত্থান শুধু শেখ হাসিনাকে বিদায় করার জন্য হয়নি, বরং গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্যও হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, আমরা চাই ডিসেম্বরের মধ্যেই তিনি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন। ওনার প্রস্থান হবে ইতিহাসে নজিরবিহীন।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের মাঝে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা এই সরকার বা জাতীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা দরকার। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতভেদ রয়েছে। এটা স্বাভাবিক। তবে সবার মতামত নিয়েই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের প্রস্তাব ছিল সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য ডিসেম্বর থেকে জুন- এই সময়ের জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা।”

তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ডিসেম্বরে মধ্যে ভোট হওয়াটাই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’

প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে সমমনা ইসলামপন্থি ৪টি রাজনৈতিক দল- খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম পার্টি। সমমনা ইসলামপন্থি দলের পক্ষ থেকে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে। আমরা প্রথমটা অর্থাৎ ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েছি। তাই সংস্কার কাজ শেষ করেই ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া উচিত হবে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বামজোটের অন্যতম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সংস্কারের নামে কী কী করতে চান তা দলগুলোকে জানান। ভালো নির্বাচন করার জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার তা করে নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা দিন। আমরা মনে করি, এটা ডিসেম্বরের অনেক আগেই করা সম্ভব। কোনোভাবেই এই বছর পার করা যাবে না। সম্ভব হলে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলে দেওয়া উচিত।’