
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) জরুরি বিভাগের বাইরে লাইন ধরে রোগীর জন্য হুইলচেয়ার এবং ট্রলি নিয়ে অপেক্ষা করছেন বয় এবং আয়ারা। খালি চোখে দেখলে মনে হবে রোগীর জন্য আন্তরিকতার শেষ নেই। রোগী আসার আগেই লাইন ধরে হুইলচেয়ার এবং ট্রলির অপেক্ষা যে কেউ প্রশংসা করতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এ যেন কাস্টমার ধরার প্রতিযোগিতা। যার আগে যিনি রোগীকে তার ট্রলি কিংবা হুইল চেয়ারে বসাতে পারবেন, তিনিই সফল। প্রতিযোগিতায় যিনি সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন, দিন শেষে তার আয় সবচেয়ে বেশি। এ যেন রোগী নিয়ে অনেকটা কাড়াকাড়ির অবস্থা। জরুরি বিভাগের বাইরের শেড, যেখানে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ায়, সেখান থেকে রোগীকে শুধু সিঁড়ি দিয়ে তুলে দিলেই কমপক্ষে ১০০ টাকা। এটা শুধু হাসপাতালে প্রবেশের চিত্র। ভিতরের অবস্থা আরো ভয়াবহ।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শনকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরম অব্যবস্থাপনা, রোগীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, অবহেলা এবং বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলছে এই হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা।
হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সীতাকুণ্ড উপজেলার পন্থিছিলা এলাকার এসএসসি পরীক্ষার্থী সাদেক জানায়, বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার পা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। হাসপাতালে গেলে গাড়ি থেকে নামার পরপরই একজন বয় তাকে হুইলচেয়ারে বসান। তার আত্মীয়-স্বজন ওই চেয়ারে করে তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয় তলায় তাকে রেফার করেন। ওই হুইলচেয়ারে তিনি লিফটে করে ছয় তলায় যান। সঙ্গে ওই বয়ও ছিলেন। এ জন্য তাকে গুনতে হয়েছে ২০০ টাকা।
রবিবার (১৬ মার্চ) দুপুর ১২টায় প্রতিবেদকের সামনেই সাদেকের পাশের রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখার সময় এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তাতেই ওই চিকিৎসকের চেহারা বেজার হয়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হল ‘ভাইয়া’ ডাকটা তার পছন্দ হয়নি। ওই চিকিৎসক সাদেকের দিকে আর ফিরে তাকাননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চমেক হাসপাতালে ১৯৩ জন আয়া-ওয়ার্ডবয় কাজ করছেন। তাদের মাসিক বেতন ১৫-১৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া বেতনহীন ওয়ার্ডবয় এবং আয়ার সংখ্যা আরও বেশি। ৪৮টি ওয়ার্ডে তারা যেন রোগীর কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়ার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত। প্রতিটি ওয়ার্ডে তিন শিফটে তারা কাজ করেন। প্রতি শিফটে তিন থেকে চারজন থাকেন। সেই হিসাবে একেকটি ওয়ার্ডে অন্তত ১০ জন ওয়ার্ডবয় ও আয়া রয়েছে। পুরো হাসপাতালে এর মোট সংখ্যা ৫০০-এর কাছাকাছি।
রোগীকে হুইলচেয়ারে করে ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা, রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ট্রলি লাগে। ট্রলির ভাড়া বেশি। সে ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা গুনতে হয়। ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পর রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি ঢুকলে নিরাপত্তাকর্মীকে দিতে হয় জনপ্রতি ২০ টাকা। এরপর বেড নেওয়ার পালা। পরিস্থিতিভেদে বেড নেওয়ার জন্য ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। নয়তো ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এরপর পরীক্ষার জন্য হুইলচেয়ারে নিয়ে গেলে ১০০ টাকা, ট্রলিতে নিয়ে গেলে ২০০ টাকা। রোগীর স্বজনরা যদি প্রতিদিন রোগীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাহলে নিরাপত্তাকর্মীকে খুশি করতে ২০ থেকে ৫০ টাকা দিতে হয়। সর্বশেষ নার্স, আয়া ও ওয়ার্ডবয়কে খুশি করতে হয় ছাড়পত্র পাওয়ার পর। টাকা না দিলে মারধরের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই এই জিম্মিদশা চলে আসছে। এমনকি টাকা ছাড়া লাশও নামাতে দেয় না। এখানে একজন পরিচালক আছেন, কয়েকজন উপপরিচালক আছেন, কলেজের অধ্যক্ষ আছেন। তারাও কি তাদের কাছে জিম্মি, নাকি তাদের আন্তরিকতা নেই?’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন জানান, আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের নিয়ে তিনি মধ্যমধ্যে বিব্রত অবস্থায় পড়েন। পুরো হাসপাতালের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। অনেক সময় অনিয়মের জন্য তাদের শাস্তিও দেওয়া হয়। তবুও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। রোগীকে জিম্মি করে টাকায় আদায় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।