
২০০৭ সাল থেকে ভোটার নিবন্ধনের পাশাপাশি এনআইডি সেবাদান কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বিগত সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকারও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রম পরিচালনার কর্তৃত্ব ইসির কাছে রাখতে চাইছে না। অন্যদিকে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানতে রাজি নয় ইসি। এনআইডি সেবাদান কার্যক্রমে কর্তৃত্ব রক্ষায় পুনরায় আন্দোলন করছেন সংস্থাটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমতাবস্থায় এনআইডির কর্তৃত্ব শেষ পর্যন্ত ইসির কাছে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এরই মধ্যে জানানো হয়েছে, এনআইডি কার্যক্রম আপাতত ইসির অধীনে থাকলেও ভবিষ্যতে এর দায়িত্ব পাবে ‘স্বাধীন ডেটা অথরিটি’। ইসির দাবি নাগরিক তথ্য সুরক্ষায় এনআইডি ও ভোটার তালিকা অভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা উচিত। এনআইডির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ও স্বাধীন ডেটা অথরিটির কাছে হস্তান্তরের ব্যাপারে- ইসি ও সরকার উভয়পক্ষই অনঢ় অবস্থানে। শেষ পর্যন্ত এনআইডির কর্তৃত্ব কার পাওয়া উচিত তা নিয়ে উভয়পক্ষই নানা যুক্তি উপস্থাপন করছে। দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে এনআইডিকে ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপকে যৌক্তিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার এনআইডির কর্তৃত্ব নিয়ে ইসি ও সরকারের টানাটানির স্থায়ী সমাধান দরকার।
নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডিকে আলাদা করার চেষ্টা এটাই প্রথম নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেও এনআইডিকে ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় ইসি থেকে এনআইডি সেবাদান কার্যক্রম সরাতে ২০১০ সালের এ সংক্রান্ত আইন বাতিল করা হয়। প্রণয়ন করা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০২৩। নতুন আইনে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে গঠিত হয় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। তবে ইসি কর্মকর্তাদের আন্দোলন আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সরকারের সেই উদ্যোগ সফল হয়নি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত জানুয়ারি মাসে এনআইডি সেবা ইসির অধীনে রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। বিষয়টি গত ১৬ জানুয়ারি নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান। এর এক মাস পরই সে অবস্থান থেকে সরে আসে সরকার। নাগরিকের দুর্ভোগ নিরসনে সম্প্রতি এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট সেবার জন্য একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। স্বাধীন ডেটা অথরিটি নামে নতুন একটি কমিশন গঠন করে এর হাতে এনআইডি সেবার কার্যক্রম দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সেই লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এনআইডি সেবা ইসি থেকে পুনরায় সরিয়ে নেওয়ার সরকারি উদ্যোগে পুনরায় প্রতিবাদ ও আন্দোলনে মাঠে নামে ইসি কর্তৃপক্ষ। এনআইডি রক্ষায় সিইসির কক্ষের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদান, স্ট্যান্ড ফর এনআইডিসহ একের পর এক কর্মসূচি পালন করেছেন ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দু-দফা কর্মসূচির পরও দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা আগামী ১৯ মার্চ ‘অপারেশন হল্ট’ নামে অর্ধদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের দাবি- এনআইডিকে নিয়ে সরকারের যেকোনো পরিকল্পনা নির্বাচন কমিশনের আওতার মধ্যে রেখেই করতে হবে।
সরকার ও ইসির বক্তব্য
এনআইডির কর্তৃত্ব ইসির কাছে থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইসি থেকে তা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল সরকার। তারা বলছে, নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডারের অধিকতর সুরক্ষায় এটাকে একটি কেন্দ্রীয় ডেটা অথরিটির অধীনে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এ বিষয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, এনআইডিতে নাগরিকদের যে ৩৫ ধরনের তথ্য আছে তা ইসির ভোটের অধিকার ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্য যৌক্তিক মনে করছে না সরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সবাই বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডটা মেনে নিক। এখন নির্বাচন কমিশন যে ডেটাবেজ মেইনটেইন করে, তারা সেটাই মেইনটেইন করবে। তবে ধীরে ধীরে এনআইডিকে একটি স্বাধীন ডেটা অথরিটির দিকে নিয়ে যেতেই হবে; যা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অথেন্টিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক, ডেটা এক্সটেন্ট ফ্রেমওয়ার্কের জন্য জরুরি।’
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘এনআইডি গড়ে উঠেছে ইসির হাতে। ভোটার তালিকার বাই প্রোডাক্ট হলো এনআইডি। এ দুটি একে অপরের পরিপূরক হিসেব কাজ করছে। দীর্ঘ দিনে আমাদের কারিগরি দক্ষ কর্মীবাহিনীও তৈরি হয়েছে। তারা এ কাজে ১৭ বছর ধরে এখানে শ্রম, ঘাম দিয়েছেন, ডেভেলপ করে এই পর্যন্ত এনেছেন নিজেদের নির্ধারিত কাজের অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে। এর নেটওয়ার্ক এখন সারা দেশে ডেভেলপ হয়েছে, এক্সপার্ট ডেভেলপ হয়েছে। এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা, নাগরিকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা ও নাগরিকের তথ্যের সুরক্ষায় ইসি তার দক্ষতাও প্রমাণ করেছে। কাজেই এনআইডি ও ভোটার তালিকা অভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা যৌক্তিক মনে করি। সার্বিক এই বিষয়গুলো সরকার বিবেচনায় নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও জানান, সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এবং ইসিতে এনআইডি রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ‘ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত’ এবং ভোটার তালিকা আইন ২০০৯-এর ধারা ১১ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী ইসি সার্বক্ষণিকভাবে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালুসহ ভোটার ডেটাবেজ সংরক্ষণ করছে। এনআইডির ডেটাবেজ অন্যখানে সরিয়ে নিলে তা যেমন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাও খর্ব করা হবে।
এনআইডি নিয়ে বিশ্লেষকের মত
এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভোটার তালিকার বাই প্রোডাক্ট হলো এনআইডি। একই জনবল দিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে নির্বাচন কমিশন এনআইডির ডেটাগুলো সংরক্ষণ করছে। এ কাজে তারা দক্ষ জনবলও তৈরি করেছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা তো এটা নিয়ে বাড়তি চাপ মনে করছে না। সরকারকে এনআইডির জন্য ভিন্ন অবকাঠামো ও বাড়তি অর্থও খরচ করতে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা এনআইডি ইসিতে অরক্ষিত না, সুরক্ষিত আছে- কেন অন্যত্র নিতে হবে? সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের এই টানাটানি দেখে অবাক হচ্ছি, কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। এর ফলে এআইডির সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে এবং পলিটিক্যালি অ্যাবিউজ হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। বিগত সরকারের সময় এনআইডিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার উদ্যোগেই আমরা তথ্য পাচারের ঘটনা ঘটেছিল। এনআইডি একটা বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আমরা ইসি থেকে এনআইডি অন্য কোনো অথরিটির কাছে পাঠানোর আগে অন্তত ৭ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছি। এ ছাড়া এনআইডির জন্য স্বাধীন কমিশন যেটা ভাবা হচ্ছে সেটা কতটা স্বাধীন হবে- সবকিছুই বিশ্লেষণের দাবি রাখে।’
ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রম- দুটি আলাদা করলে নির্বাচন ও এনআইডি সেবার কাজে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান আরজু। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনআইডির জন্ম হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। ভোটার তালিকা ও এনআইডির তথ্য একে অপরের পরিপূরক। উভয়ে একই ডেটাবেজের ওপর নির্ভরশীল। এনআইডিকে কমিশন থেকে আলাদা করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছি না। কারণ ইসির কাছে এনআইডির তথ্য সুরক্ষিত আছে। বরং এটা অন্যখানে নিলে ব্যাহত হবে নাগরিক সেবা, বাধাগ্রস্ত হবে নির্বাচন ব্যবস্থা। এ বিষয়টি অনুধাবন করে অন্তর্বর্তী সরকারও কিন্তু বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে এনআইডি ইসির অধীনেই রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা কেন সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেল বুঝতে পারছি না। কারণ এনআইডি ইসিতে থাকায় সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনআইডি সেবা ইসিতে থাকায় এ কাজে সরকারকে আলাদা জনবল নিতে হয়নি, যা সাশ্রয়ী সেবায় পরিণত হয়েছে। তবে আলাদা কমিশন বা কোনো সত্তা তৈরির উদ্যোগে সরকারকে এনআইডির জন্য জনবল, ডিজিটাল পরিকাঠামো, স্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধাদি তৈরিতে অনেক অর্থ সরকারকে ব্যয় হবে। এনআইডি সেবা স্থানান্তরে সরকারের উদ্যোগে এরই মধ্যে আমাদের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবলে আঘাত করেছে, নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া চাকরি হারানোর শঙ্কায় এনআইডি প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ২ হাজার ২৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। অথচ এই কমিশনের প্রশিক্ষিত জনবল নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম, ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম এবং এনআইডি সেবাদানে সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রকল্প ও রাজস্ব খাতের মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার লোকবল এনআইডি সেবাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া প্রায় ৫ হাজার কোটি ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছে একটি সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার।
দেশের নাগরিক তথ্য ও জনসেবা সম্পর্কিত কোনো ডেটাবেজই যেখানে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জাতীয় আস্থা অর্জন করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকাসহ এনআইডি ডেটাবেজ একটি সফল ব্যতিক্রম।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে, দালাল ও অসাধু চক্রের কর্মকাণ্ড রোধে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য নাগরিক তথ্যাদির রক্ষণাবেক্ষণে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়। কাজেই জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা সাংবিধানিক এই সংস্থাটির কাছে কাছে থাকায় এক ধরনের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।