
নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ নানা ধরনের যাচাই-বাছাই পেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সময় নির্ধারণ করেছে।
গত মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৬ সালেই এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসবে। এ জন্য যেসব প্রস্তুতি দরকার, তা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। যদিও এর এক দিন আগে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ‘ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হতে চাচ্ছি। সে জন্য বিষয়টি আরও পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বাংলাদেশ সরকার চাইলেই তা পিছিয়ে যাবে না। সরকার তাই জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করবে।’ তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ পুনর্বিবেচনা করতে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে দেশের মর্যাদা আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। তবে এ জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং উদ্যোক্তা উভয়কেই যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুই দিক থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজস্ব খাত ঠিক করতে হবে এবং শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির বিষয়েও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, চীন ও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। প্রস্তুতি নিতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা নেওয়ার জন্য। আর উদ্যোক্তা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশের জন্য ডব্লিউটিওর যেসব নিয়মকানুন আছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বেশ কিছু আমদানি নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, শুল্কমুক্ত সুবিধা যখন থাকবে না, তখন প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষত চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি বাড়বে। সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। যাতে আমাদের উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে। এসব প্রস্তুতি না নিলে আমরা বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়ব। তাই এই ধরনের ক্ষতিতে যেন আমাদের পড়তে না হয়, সে জন্যই ভালো প্রস্তুতি দরকার।’ তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ যে নগদ প্রণোদনা দেয়, সেই প্রণোদনার আসক্তি থেকে বের হতে হবে। একক রপ্তানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা আর নয়। যেতে হবে বহুধাকরণে। পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।
জানা গেছে, পাঁচ দশক ধরে এলডিসির তালিকায় আছে বাংলাদেশ। এলডিসিতে থাকা দেশগুলো মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে থাকা দেশ। স্বল্পোন্নত দেশগুলো যাতে এগিয়ে যেতে পারে এবং নিজেদের উন্নতি করতে পারে, সে জন্য উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের সুবিধা দেয়। বাংলাদেশও এসব সুবিধা পেয়ে আসছে। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে প্রথম এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমান যে অগ্রগতি, তার মূল কারণ এই এলডিসিভুক্তি।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সুপারিশ অনুযায়ী, ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে বাংলাদেশের। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, সিডিপির পক্ষ থেকে প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়।
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। কারণ এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত।
এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের ঔষধ শিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ঔষধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ পায়। ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ঔষধ শিল্পের এই সুবিধা থাকবে না। আর ২০২৬ সালের পর ট্রিপস সুবিধা থাকবে না। ফলে ২০ শতাংশ ওষুধের প্যাটেন্ট দিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। বিশেষ করে ২৬ সালের নভেম্বরে উত্তরণের পরপরই বেশ কিছু ওষুধের মেধাস্বত্ব সুবিধা ভোগের জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এতে ওষুধের প্রকারভেদে দাম বেড়ে যাবে। বিশেষ করে ইনসুলিনের প্যাটেন্ট কিনে ব্যবহার করলে দাম বাড়বে কমপক্ষে ৮ গুণ। এ জন্য আগাম প্রস্তুতি না থাকলে সমস্যায় পড়তে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর কৃষি খাতেও বড় ধরনের চুক্তি দরকার।
এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদা দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে।
সম্ভাবনা
এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে লাভটি হবে, তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবে।