
স্বাধীনতার আগে দেশে সাধারণ ও বিশেষায়িত মিলিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৬টি। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ৫৫-তে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যেই প্রায় ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আরও গোটা দশেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলাদাভাবে সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য অবরোধ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি করার প্রস্তাব দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তবে দেশের জনসংখ্যা, আর্থিক সক্ষমতা, বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান, গবেষণা, শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকট, উচ্চশিক্ষিত বেকার গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশে বর্তমানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন তো অনেকগুলো বড় কলেজ রয়েছে, যা অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে শিক্ষকসংকট রয়েছে। কেউ যেতে চান না। মফস্বলে প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসররা যেতে চান না। সবাই ঢাকায় থাকতে চান। এই কলেজগুলো যদি ঠিকমতো চালানো যায়, তাতে যদি প্রয়োজন মেটে তাহলে আমার মনে হয় না নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সমস্যার সমাধান হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে শিক্ষক সমস্যা। ঢাকার বাইরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না। শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যেগুলো আছে অর্থাৎ যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি দেওয়া হয় সেসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্তিশালী করা দরকার।’
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৩টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯টি, রাজশাহী বিভাগে ৫টি, খুলনা বিভাগে ৫টি, বরিশাল বিভাগে ৩টি, সিলেট বিভাগে ৬টি, রংপুরে ৪টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই হিসাবের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইউনিভার্সিটি নওগাঁ ও মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইউজিসির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও একটির খসড়া জাতীয় সংসদে পাস হয়। আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন ছিল।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাধীনতার পরে ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হয় ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায় ১৯টি।
দেশে ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বৈশ্বিক মানদণ্ডে তাদের অবস্থান তলানিতে। কিউএস র্যাঙ্কিং ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং-এ ৫০০-এর মধ্যে নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এশিয়ার ১০০-এর মধ্যেও নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ভারত, চীন, সিঙ্গাপুরের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছে।
অপরদিকে দক্ষ শিক্ষকের সংকট রয়েছে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডিবিহীন প্রফেসর যেমন রয়েছে, আবার অনেক শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিম্নমানের। গবেষণা খাতে নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের বড় অংশই চলে যায় শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও পেনশনে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নানা সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য।
কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আসতে পারে আরও
রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করা হয়েছে। এই সাত কলেজকে নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। এসব কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক চালু আছে। আবার শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা আছেন প্রায় হাজার খানেক। বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে উচ্চ মাধ্যমিক ও শিক্ষক নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হবে। আবার এসব কলেজ রাজধানীর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য ভালো কলেজ হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভালো কলেজের সংকট দেখা দেবে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
সাত কলেজের জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ চলমান। এরই মধ্যে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে না থেকে আলাদাভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই দাবিতে তারা রাজধানীতে এক সপ্তাহ অবরোধ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এতে ভোগান্তির শিকার হয় জনসাধারণ। তাদের এই দাবিকে অধিকাংশই অযৌক্তিক বলছেন। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে দেশের আরও প্রাচীন কলেজ রয়েছে যেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় করা যাবে। ফলে তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে মাঠে নামতে পারে। এসব কলেজের মধ্যে রয়েছে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে অনেকে বর্তমানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটির এখনো জমি অধিগ্রহণই হয়নি। রয়েছে শিক্ষক সংকট। ভাড়া করা বাসায় পাঠদান চলছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হলেও নেই পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা। প্রতিষ্ঠার বিশ বছর পার হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নেই আবাসিক সুবিধা।
দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আবাসনসহ নানা সংকট। অ্যাকাডামিক মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই চলে কার্যক্রম। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান সন্তোষজনক না হওয়ায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছেন শিক্ষাবিদরা।