
পুঁজিবাজার থেকে পরিকল্পিতভাবে বিশাল অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করে বেশ কিছু কোম্পানি এখন নিজেদের অস্তিত্বকে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তারা বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এসব কোম্পানি বর্তমানে নিজেদের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গেছে।
গত সাত বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৫৬টি কোম্পানি। সব কটি কোম্পানি মিলে পুঁজিবাজার থেকে তুলে নিয়েছে ৫ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে এখন ২৪টি কোম্পানি জেড ও বি ক্যাটাগরিতে নেমে এসেছে। এই কোম্পানিগুলো (২৪টি) পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করেছে। তারপরও কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি নেই।
২০১৯ সালে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আইপিও ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড। ঢাকা ইপিজেডের এই কোম্পানিটি এখন অস্তিত্বসংকটে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মানের কোম্পানি গঠনের লক্ষ্যে অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন আইপিও ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে। কোম্পানিটি এখন লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এটিও এখন জেড ক্যাটাগরিতে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পূর্বশর্ত আগের তিন বছর ধারাবাহিক মুনাফা অর্জন। লভ্যাংশ অর্জন করা একটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে থাকে আরও ভালো ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুত্তীর্ণ কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে আইপিও ছেড়ে অর্থ উত্তোলন করেছে।
তারা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনরা পরিকল্পিতভাবে কোম্পানি গঠন করে অথবা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে গঠন করিয়ে অর্থ উত্তোলনের নামে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ লুটপাট করেছেন। প্রভাবশালীরা ক্ষমতার বলয় ব্যবহার করে মনগড়া আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। ফলে সেই ক্ষতই এখন পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে রয়ে গেছে।
বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর ১১ বছর ব্যবসা করে ২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ব্যাংকঋণ পরিশোধসহ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বলে কোম্পানিটি উত্তোলন করে ১৯ কোটি টাকা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় কোম্পানিটির একটি শেয়ারের জন্য ৩৭ জন বিনিয়োগকারী আবেদন করেছিলেন। বিনিয়োগকারীদের সেই আগ্রহে ছাই ঢেলে ২০২৪ সালে কোম্পানিটি নেমে আসে জেড ক্যাটাগরিতে। পুঁজিবাজারের ভাষায় এটি এখন দুর্বল খাতের কোম্পানি।
২০১৯ সালে ৯টি কোম্পানি আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই সময়ে ৯টি কোম্পানি মিলে পুঁজিবাজার থেকে নিয়েছে ৬৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬টি কোম্পানি এখন জেড ক্যাটাগরিতে। যারা সম্মিলিতভাবে পুঁজিবাজার থেকে নিয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এই ছয়টির মধ্যে আবার দুটি এখন একেবারেই বন্ধ।
সম্প্রতি আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বলছেন, ‘২০১৩ ও ২০১৪ সালে যেসব বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে টাকা লুটপাট করা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আর তালিকাভুক্ত হতে না পেরে গ্রাহকের টাকা মেরে দিয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছি।’
পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতের কোম্পানি নিউ লাইন ক্লোদিং লিমিটেড ২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়ে নিয়ে গেছে ৩০ কোটি টাকা। কোম্পানিটি যখন তালিকাভুক্ত হয়, তখন এর একটি শেয়ারের জন্য ২৮ জন আবেদন করেছিলেন। সেই কোম্পানি এখন জেড ক্যাটাগরিতে। ২০২১ সালের পর থেকে কোম্পানিটি কোনো আর্থিক প্রতিবেদনই প্রকাশ করছে না।
২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেড উত্তোলন করেছে ৩০ কোটি টাকা। তিন বছরের মাথায় কোম্পানিটি লভ্যাংশ দেওয়া কমিয়ে দেয়। ২০২৪ সালে মাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি লুব-রেফ বাংলাদেশ লিমিটেডও ২০২১ সালে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করেছে ১৫০ কোটি টাকা। তালিকাভুক্তির ৩ বছরে মুনাফার বদলে ক্রমাগত লোকসানের মুখে কোম্পানিটি এখন লেনদেন হচ্ছে জেড ক্যাটাগরিতে।
তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ও বছরে ১০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিচ্ছে সেগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত। ৫ শতাংশের বেশি এবং ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দিলে ‘বি’ ক্যাটাগরিভুক্ত এবং নিয়মিত লভ্যাংশ দিচ্ছে না, আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না এমন কোম্পানিগুলো ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত।
পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা ধরে রাখতে পারে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এর জন্য দুটি বিষয়কে দায়ী করা যায়, এক. কোম্পানির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি ও বিএসইসির যথাযথ তদারকির অভাব।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিংহভাগ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দেওয়া হয়, যা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে।’
আবু আহমেদ বলেন, ‘কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের টাকা নিয়ে কোম্পানিগুলো কী করেছে তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।’
ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে যে টাকা উত্তোলন করে তার ৭০ শতাংশই ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যয় করে থাকে, যা কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটায়। তবে উৎপাদনে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এই ধারা বন্ধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে আসার জন্য বিগত তিন বছর ধারাবাহিকভাবে মুনাফায় থাকতে হয়, কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানি দুর্বল হয়ে যায়, নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। বিগত সময়ে এমন যতগুলো কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে বন্ধ হয়েছে বা বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, যে সময় যে কমিশন ছিল তারাই এসব কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে। আইনগতভাবে এসব কোম্পানির বোর্ড ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা বিএসইসির আছে। বিগত সময়ে এমন অনেক কোম্পানির বোর্ড পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে কোনো কাজই হয়নি।
তিনি বলেন, নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশন খুবই সচেতন। বিগত সময়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারাই তালিকাভুক্ত হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।