ঢাকা ৪ বৈশাখ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

ডিসেম্বরে ভোট নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:০৫ এএম
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:২৩ এএম
ডিসেম্বরে ভোট নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দলটি মনে করছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকারসংশ্লিষ্টদের মতামত এক জায়গায় স্থির থাকছে না। তারা ডিসেম্বর, মার্চ ও জুন- এই তিন সময়কে সামনে এনে একেকজন একেক সময় একেক কথা বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও তার বক্তব্যে কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলছেন না। ফলে ডিসেম্বরে আদৌ ভোট হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।

সবশেষ গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাতে খুব বেশি সময় নেই, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এর দুই দিন আগেই গত শুক্রবার ঢাকায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ এখানে ছয় মাস নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সামনে রেখে তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে বিএনপিতে নতুন করে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ দুই বক্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন বিএনপি নেতারা। ডিসেম্বর বা জুনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করারও চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদের কেউ কেউ মনে করেন। তারা বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন করতে কত দিন সময় লাগবে সরকারের সে বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা উচিত, তা না হলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও জনগণের দূরত্ব বাড়তে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টা তার কথা রাখবেন এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড।’ অর্থাৎ যদি কোনো জাজমেন্ট দিতে দেরি হয়, তাহলে বুঝতে হবে জজ সঠিক রায় দেবেন না। রায় যদি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন তাহলে বুঝতে হবে, এটা সঠিক রায়। আর যদি রায় না দেন তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যদি সঠিক সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশ ও জনগণ আরও সংকট পড়বে। জনগণের কপালে দুর্ভোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তার সরকার। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জানিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়ে কমিশনের কাজ এগোচ্ছে। সবশেষ গত ১০ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর সময়সীমা পার করতে চায় না ইসি। অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে চায় ইসি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রধান উপদেষ্টার একেক সময়ে একেক বক্তব্যে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

পাশাপাশি ওই বক্তব্যের পরে রাজনৈতিক মহলেও নতুন করে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে, নির্বাচন আদৌ এ বছরের ডিসেম্বরে হবে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবকে কোনো কথা বলা মানে এর তাৎপর্য অনেক বেশি। তারা সন্দেহ করছেন, ডিসেম্বরে ভোট না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ থাকতে পারে। তাই নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ স্পষ্ট করতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন ঠেলতে ঠেলতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। আর পরিস্থিতি এমন হলে আগামী দেড় থেকে দুই বছরে অনেক ঘটনায় দেশের রাজনীতির মাঠে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে।

জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা উপহার পায়। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ দল ভোট বর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু একবারই বিশেষ কারণে জুনে ভোট হয়েছে। জুন-জুলাই মাসে বর্ষা ও গরমের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির কম।

তাই জুন-জুলাইয়ে আগামী নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, গরম ও বর্ষার মধ্যে ভোটাররা ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করেন না। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা থাকে। তাই শীতের সময়টিতে নির্বাচনের জন্য সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব দিক বিবেচনা করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে তা পরবর্তী বছরের অক্টোবরের আগে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকে।

নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব দৃশ্যমান রয়েছে। এ প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর মনোভাব আবার সরকারের কাছাকাছি। এ কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকার ও ছাত্রদের মধ্যে সখ্য দেখছে বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কারণেই বিএনপিতে সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে, সরকার আদৌ নির্বাচন দেবে কি না? এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে চাপে রাখতে এপ্রিলে মাঠের আন্দোলনে যেতে পারে বিএনপি।

জানা গেছে, ঈদের পর এই ইস্যুতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগামী জুন-জুলাই নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময়। সংস্কার-সংস্কার করে নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়োজন নেই। কিছু সংস্কার হয়েছে, বাকিগুলো করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক।’ তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ডিসেম্বরের কথা বলেছেন, আবার বেশি সংস্কারের জন্য পরের বছরের জুনের কথা বলেছেন। তবে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ নির্বাচন চায়। যদি কারও কথায় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, তাহলে দেশের ক্ষতি হবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার আসবে না। আবার যদি এই সরকারের মধ্যে ফ্যাসিস্ট আচরণ জন্ম নেয় তাহলে জনগণ আশাহত হয়ে পড়বে। সে জন্য দ্রুত নির্বাচন দেওয়া জরুরি বলে মনে করি।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে কোন বছরের কোন মাসের কত তারিখে নির্বাচন হবে- তার রোডম্যাপ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো দেয়নি। ফলে সরকারের নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি সরকার ক্ষমতা ছাড়লে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই বিতর্ক করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিলম্ব করলে সরকারের জন্য বিপজ্জনক। দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংশয়ের মূলে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং এনসিপি নেতাদের নানা কথাবার্তা। বিএনপি মনে করছে, সরকার ও ছাত্ররা নির্বাচন হোক এটা চাইছেন না। বিশেষ করে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারসহ কয়েকজন উপদেষ্টা নির্বাচনের বিপক্ষে। ছাত্রনেতারা ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। এ জন্য তারা বৃহৎ সংস্কারের কথা তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। 

উত্তপ্ত কারিগরি শিক্ষাঙ্গন: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেপথ্যে শিক্ষকদের একাংশ

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৭ এএম
আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪২ এএম
উত্তপ্ত কারিগরি শিক্ষাঙ্গন: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেপথ্যে শিক্ষকদের একাংশ
চট্টগ্রামের ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, জনসাধারণের দুর্ভোগ। ছবি: খবরের কাগজ

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টররা দীর্ঘদিন পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এর ফলে আদালতে একটি মামলা করেছেন ক্রাফট ইন্সট্রাক্টররা। এ বিষয় নিয়ে অপর একটি শিক্ষক মহল কারিগরি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে আন্দোলনে নামিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এখানে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরণের স্বার্থ না থাকলেও শিক্ষকদের প্ররোচনায় সড়ক দখল করে অবরোধ করছেন তারা। এদিকে গত ২০ মার্চ থেকে  ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করতে চান শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সিন্ডিকেট। যদিও আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে কারিগরি অধিদপ্তর বিব্রত বলে জানা গেছে।  

সব শেষে বুধবার (১৭ এপ্রিল) সকাল থেকে সারা দেশে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত রমজান মাসে আন্দোলন করে সড়ক অবরোধ করেছিলেন তারা। আদালতে মামলার রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বার বার জনদুর্ভোগ তৈরি করে সড়ক অবরোধ করছেন শিক্ষার্থীরা। 

জানা গেছে, সম্প্রতি আদালতের দেওয়া একটি রায়কে কেন্দ্র করে দেশের কারিগরি অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষের উপর। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর বা দক্ষ প্রশিক্ষক পদটি কারিগরি শিক্ষার অর্গানোগ্রাম, প্যাটার্ন, বাংলাদেশ সরকারের গেজেট, মন্ত্রণালয়ের আদেশ, বদলির আদেশ, প্রশিক্ষণ আদেশ অনুযায়ী শিক্ষক পদ। দেখা গেছে, কারিগরিতে যারা শ্রেণি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই নির্দিষ্ট মেয়াদ চাকরি করার পর ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পদোন্নতি পাচ্ছেন। কিন্তু সবার পদোন্নতি থাকলেও  ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদধারীদের কোনো পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি। অন্যদের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা পাশ করে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর ১০ম গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে পর্যায়ক্রমে ৪র্থ গ্রেডে অধ্যক্ষ পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেকেই ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদে নিয়োগ পেয়ে কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসর নিচ্ছেন। 

সম্প্রতি আদালতের রায়ে গত ৫০ বছরের একটি অমীমাংসিত বিষয় সমাধান হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের ভুল বুঝিয়ে রাজপথে নামিয়ে দেন এ রায়ের বিরুদ্ধে থাকা পলিটেকনিক শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। ফলে সারাদেশে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে মানুষকে জিম্মি করে আদালতের রায় বাতিল করতে চাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের বোঝানো হয়েছে, জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদটি তাদের জন্য বরাদ্দ করা। পদটি ক্রাফট ইন্সট্রাক্টররা ৫০ শতাংশ নিয়ে গেলে তাদের পদ কমে যাবে। অথচ তারা যে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের ৫০ শতাংশ পদ নিয়ে যায়, সেই ব্যাপারে বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা কোনো প্রতিবাদ করেন না। ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদে বর্তমানে পদার্থ ও রসায়নে অনার্স পাসদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের সংখ্যা প্রায় ১০০০ জন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ৫০০ জন, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ৫০০ জন। অল্প কিছু লোক আছেন, যারা এইচএসসি ভোকেশনাল পাশ। অর্থাৎ এই পদে অর্ধেকের বেশি লোকই কারিগরি শিক্ষা থেকে আসা। 

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর মীর মো. বায়জীদ হোসেন ও মো. রুবেল মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমরা পদোন্নতি পাই না। কেউ বঞ্চিত হলেও কি আদালতে যাওয়া যাবে না? কেউ আদালতে গেলে তাকে ছাত্র লেলিয়ে হেনস্থা করা কি বিবেকবান মানুষের কাজ? যারা আদালতে গিয়েছেন তাদেরসহ এই পদের সবাইকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নিজের কর্মস্থলে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, যাদের যোগ্যতা আছে কেবল তারাই পদোন্নতি পাবেন। এখানে অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তবুও আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’ 

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সপ্তম পর্বের শিক্ষার্থী তকির আহমেদ শমীক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষা থেকে এসে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর হয়ে এখন প্রমোশনের জন্য আদালতে মামলা করা হয়েছে। এদের প্রমোশন দিলে কারিগরি থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদে কারিগরি থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরাও চাকরি করছেন দীর্ঘদিন থেকে। তাদের প্রমোশন হচ্ছে না। এ পদ থেকে উপরের দিকে যেতে পারছেন না।’ তিনি শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘যোগ্যতা থাকলে চাকরিতে প্রমোশন পাওয়ার অধিকার সবার আছে। তাদের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আপত্তি নেই। তারা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলন করছেন।’ 

কারিগরি শিক্ষার এ অচলাবস্থা নিয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক  শোয়াইব আহমাদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য খুবই বিব্রত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। কারিগরিতে নতুন করে চাকরি বিধি প্রণয়ন করতে হবে। যদিও এটি সময়ের ব্যাপার। ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের দাবির বিষয়ে একটি মামলা চলমান আছে।’ এখানে শিক্ষার্থীদের জড়িত হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বুঝাবে কে? এখানে শিক্ষার্থীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা নয়। কিন্তু অপর শিক্ষকদের প্ররোচনায় শিক্ষার্থীরা মাঠে নামছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে চাকরি করার অধিকার সবার আছে। প্রমোশন চাওয়ার অধিকারও সবার আছে। সবাইকে নিয়ে এক টেবিলে বসে সমস্যা সমাধান করা হবে, সেই পরিস্থিতিও এখন নেই।  এ বিষয়ে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

পুরোনো রূপে ভোজ্যতেলের বাজার, ক্রেতার নাভিশ্বাস

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৮ এএম
আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৩ এএম
পুরোনো রূপে ভোজ্যতেলের বাজার, ক্রেতার নাভিশ্বাস
চট্টগ্রামে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। ছবিটি চট্টগ্রাম মহানগরের খাতুনগঞ্জ-সংলগ্ন বকশিরহাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: খবরের কাগজ

চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের বাজার লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ৭ টাকা ২৩ পয়সা ও পাম অয়েলে ৮ টাকা ৬৮ পয়সা বেড়েছে। সবমিলিয়ে আবারও আগের রূপে ফিরে গেল ভোজ্যতেলের বাজার। এদিকে বাড়তি দরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। 

গত ২৭ মার্চ খাতুনগঞ্জে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৫ টাকা ৯০ পয়সা ও পাম অয়েল ১৩৫ টাকা ৫৩ পয়সায় বিক্রি হয়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ৭ টাকা ২৩ পয়সা ও পাম অয়েলে ৮ টাকা ৬৮ পয়সা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৫৩ টাকা ১৩ পয়সা ও পাম অয়েল ১৪৪ টাকা ২১ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। 

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজান মাসে বাজার দর স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক, কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। গত ৩১ মার্চ এ সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাই কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছে। 

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মিলমালিকদের কাছ থেকে বাড়তি দরে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল কিনে আনতে হচ্ছে। তাই পাইকারিতেও দাম অনেক বেড়ে গেছে। ভোজ্যতেলের বাজার কখন স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’ 

মিলমালিকরা তেলের দাম বাড়াতে সর্বপ্রথম গত ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) জানায়। পরে গত ১৩ এপ্রিল সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি ১৪ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সেদিন থেকে দাম কার্যকর করার ঘোষণা দেয় সংগঠনটি। 

তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে গত ১৫ এপ্রিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনে ১৪ টাকা বেড়ে ১৮৯ টাকা এবং খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলে ১২ টাকা বেড়ে ১৬৯ টাকায় বিক্রি হবে।  

এদিকে খুচরা বাজারে নির্ধারিত দামের বাইরে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ১৯২ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেলে খুচরা ব্যবসায়ীদের কারসাজি নতুন নয়। গত ৪ মার্চ দুপুরে ভোজ্যতেল এবং নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সার্কিট হাউসে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ দামে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেননি। 

নগরের পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘রান্নায় তেল লাগেই। না কিনেও উপায় নেই। কিন্তু এর চাহিদাকে পুঁজি করে যখন তখন দাম বাড়িয়ে দিলে আমাদের সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। হুট করেই বোতলজাত ভোজ্যতেলে ১৪ টাকা বাড়ানো হলো। কিন্তু আমাদের আয় তো নির্দিষ্ট। কাজেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে এ ব্যাপারে সরকারের কড়া নজরদারি থাকা উচিত।’

গত বছরের ডিসেম্বরে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক, কর ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ায় গত চার মাসে (ডিসেম্বর-মার্চ) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমাণে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮৫৩ টন, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৫২৭ টন এবং মার্চে ১ লাখ ৩৬ হাজার টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সেগুলোই পরিশোধন করে বাড়তি দরে বিক্রি হবে বলে দাবি করছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। 

সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতির দিকে। অন্যদিকে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক, কর ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। সেগুলোই এখন পরিশোধন করে চড়া দামে বিক্রি হবে। আমরা বলতে চাই, মিলমালিক ও ট্যারিফ কমিশন কীভাবে হিসাব করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়াল, সেটা জনসমক্ষে আনা উচিত।’ 

এদিকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের পকেট কাটার উৎসব থামানো যাবে না বলে জানিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে গতকাল বুধবার  বিকেলে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বিবৃতি দিয়েছেন।  

ভারতীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ: খরচ বাড়বে শিল্পের অনেক খাতে

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:০০ এএম
আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৮ পিএম
ভারতীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ: খরচ বাড়বে শিল্পের অনেক খাতে
ছবি: সংগৃহীত

দেশের ব্যবসায়ীদের সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই অনেকটা বিনা নোটিশে ভারত থেকে বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানিতে দেওয়া হয়েছে শর্ত, স্থলপথ দিয়ে আনা যাবে না, আনতে হবে বিকল্প পথে।

দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা এ সিদ্ধান্ত বাতিলের জোর দাবি জানিয়ে বলেছেন, স্থলবন্দরের পরিবর্তে বিকল্প পথে আমদানি করা হলে দেশে সুতা পৌঁছাতে সময় বেশি লাগবে। আমদানি করা এসব সুতা দিয়ে পণ্য বানিয়ে বায়ারদের বেঁধে দেওয়া সময়ে রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। সংকটে পড়বে তৈরি পোশাকশিল্প, যা সমগ্র রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত। ভারত সরকারের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পাল্টা হিসেবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে শর্ত ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ধরে নিয়ে বলা যায়, এভাবে পাল্টাপাল্টি চলতে থাকলে দুই দেশের কারোর জন্যই ভালো হবে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, সরকার বেশ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্যদিকে সুতা আমদানি সীমিত করেছে। সরকার তো ব্যবসা করে না। ব্যবসা করে বেসরকারি খাত। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যগুলো যেসব খাতের কাঁচামাল সেই সব রপ্তানি খাত চাপে পড়বে। তাই এ সিদ্ধান্ত অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণ করা উচিত ছিল।

অর্থনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে সুতা উৎপাদন হলেও তা দামে ও মানে ভারতের সুতার বিকল্প কি না, তা দেখতে হবে। এর আগেও সুতা আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। আবার খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া অন্য যেসব পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেসব সমজাতীয় পণ্য উৎপাদনে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান সক্ষম কি না, তাও বিবেচনায় রাখা দরকার ছিল।’

তিনি আরও বলেন, মনে রাখতে হবে ভূরাজনীতির কারণে দুই দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দুই দেশকেই সরে থাকতে হবে। ভারত সরকারের নেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশ এটা করেছে এমন কথাও অনেকে বলছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশকে যেমন অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়, একইভাবে বাংলাদেশের রপ্তানির বড় বাজার ভারত। পাল্টাপাল্টি আক্রমণ দুই দেশের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি ও বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত। করোনার পর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ডলারসংকটে আমরা বিপর্যস্ত। কোনোমতে টিকে আছি। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা, ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানিতে এমন শর্ত কীভাবে দেয় তা আমরা জানতে চাই।’

তিনি বলেন, স্থলবন্দর দিয়ে অল্প পরিমাণ সুতা ও ডুপ্লেক্স বোর্ড এনে সাধারণ ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। পানিপথে বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আনতে হয়। এভাবে সাধারণ ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের স্থলবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুপারিশে টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি রাখতে ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এনবিআর এ কাজ করেছে। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে জোর দাবি জানাচ্ছি।’

তৈরি পোশাক খাতের আরেক ব্যবসায়ী রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমদানি নিষিদ্ধ এবং শর্ত দিয়ে আমদানি করা পণ্যের সমজাতীয় পণ্য রাতারাতি তো আর দেশের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব না। আবার নতুন বাজার খুঁজে এসব পণ্য আমদানি করতে তো সময় লাগবে। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বিনা নোটিশে সরকার এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তৈরি পোশাকসহ শিল্পের বিভিন্ন খাত চাপে পড়বে। বিশ্ববাণিজ্যের এমন পরিস্থিতিতে এসব শিল্প খাতে খরচ বাড়বে।’

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নতুন সভাপতি আবদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক খাতে কেবল রেডিও-টিভি, সাইকেল ও মোটরের যন্ত্রাংশ, ফরমিকা শিট, সিরামিকওয়্যার, স্যানিটারিওয়্যার, স্টেইনলেস স্টিলওয়্যার, মার্বেল স্ল্যাব ও টাইলস এবং মিক্সড ফেব্রিকস ব্যবহৃত হয়। কোনো সময় না দিয়েই এসব পণ্য নিষিদ্ধ করায় পণ্য সংকট হবে। আগেই যারা পণ্য আমদানি করে রেখেছিলেন তাদের অনেকে সেই সব সমজাতীয় পণ্য কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের জন্যই নেতিবাচক নয়।’

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বস্ত্র খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায় বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এরপর গত মার্চ মাসে এক চিঠিতে পোশাকশিল্পে দেশে তৈরি সুতার ব্যবহার বাড়াতে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাকশিল্পের সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য এনবিআরকে ব্যবস্থা নিতে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) নতুন সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকীন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, সম্প্রতি ভারত থেকে সুতা, দুধ, গুঁড়া দুধ, মাছ, আলু, নিউজপ্রিন্ট, ডুপ্লেক্স বোর্ড, ক্রাফট পেপার, সিগারেট পেপার, টোব্যাকো, রেডিও-টিভি পার্টস, সাইকেল ও মোটর পার্টস, ফরমিকা শিট, সিরামিকওয়্যার, স্যানিটারিওয়্যার, স্টেইনলেস স্টিলওয়্যার, মার্বেল স্ল্যাব, টাইলস এবং মিক্সড ফেব্রিকসসহ একাধিক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। ভারতীয় সস্তা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্থানীয় উৎপাদকরা দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে পড়ছিলেন। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশীয় শিল্প বিশেষ করে সুতা, সিরামিক ও নির্মাণসামগ্রী খাতে আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথ সুগম হবে। এতে প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি শিল্প সক্ষম করতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। কত দিনে সক্ষমতা তৈরি হবে, তাও ভেবে দেখা দরকার ছিল।

ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, তবে এই পরিবর্তনের ফলে কিছু পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে, যা ভোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত সুতার দাম বেড়ে গেলে রপ্তানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তদুপরি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যারা ভারতীয় পণ্য নির্ভর ছিলেন, তারা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। চীন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আমদানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রণোদনা, পর্যাপ্ত ইউটিলিটি সার্ভিস প্রদানসহ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখা, শুল্ক সুবিধা এবং সহজ ঋণ প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে শুরু হচ্ছে কার্গো ফ্লাইট

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৫ এএম
আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৭ পিএম
সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে শুরু হচ্ছে কার্গো ফ্লাইট
ছবি: সংগৃহীত

ভারত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এরপর দুই দিনে পাঁচটি ট্রাক ফিরিয়ে দেয় দেশটি। এতে পণ্য বিদেশে পাঠানো নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে ২৭ এপ্রিল থেকে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হবে। প্রথম দিন কার্গো ফ্লাইট যাবে স্পেনে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া এ কথা জানিয়েছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও শিগগির কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হবে।

বাংলাদেশ কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪৬২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এই সময়ের মধ্যে ভারত হয়ে বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টন পোশাক। ফলে সম্প্রতি ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করায় বিকল্পের সন্ধান করতে হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের।
এ অবস্থায় সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইটে পণ্য পরিবহনের দাবি সামনে আনেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে টাওয়ার ফ্রেইট লজিস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েসনের (বাফা) ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়টিকে কেবল নেতিবাচকভাবে না দেখে সম্ভাবনার দিক থেকেও ভাবার সুযোগ রয়েছে। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দেওয়ায় রপ্তানি খাতে সাময়িক সমস্যা হবে। তবে আমরা সক্ষমতা বাড়াতে পারলে তা আমাদের জন্য একটি সুযোগে পরিণত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারত থেকে রপ্তানি করলে পরিবহন ব্যয় কম লাগত। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করলে খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়। এ বিষয়ে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। দেশের কার্গো সুবিধা বাড়াতে হলে খরচ কমাতে হবে, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস ভালো করতে হবে এবং সময়মতো সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে।’

কার্গো সুবিধা ইস্যুতে দেশের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাণিজ্য এবং বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, ‘ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় বাংলাদেশ বড় কোনো সমস্যায় পড়বে বলে মনে হয় না। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব অংশীজন, বাংলাদেশ বিমান, সিভিল এভিয়েশন, প্রাইভেট সেক্টর সবার সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। সমস্যা উত্তরণে কিছু অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, কিছু বাড়তি খরচের বিষয় রয়েছে। আমরা কাজ করছি, আশা করছি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।’ 

এরই অংশ হিসেবে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বেবিচক কর্মকর্তারা। তারা বলেন, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ক্যাটাগরি ১-এ উন্নীত হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (আইকাও) একটি প্রতিনিধিদল বিমানবন্দর দুটি পরিদর্শন করে এ ঘোষণা দেয়। এ দুটি বিমানবন্দর দিয়ে কার্গো ফ্লাইট চালু হলে একদিকে ভোগান্তি কমবে, অন্যদিকে বাড়তি অর্থ ও খরচ বাঁচবে ব্যবসায়ীদের। 

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, পণ্য রপ্তানিতে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা ও পণ্য রপ্তানির জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৭ এপ্রিল প্রথম কার্গো ফ্লাইট উড়াল দেবে সিলেট থেকে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়েও এই সুবিধা চালু হবে।

দেশের সব বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে আসা প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসই এবারও এই সেবা দেবে। বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কার্গো ফ্লাইটের সব সুবিধা যেন ঠিকভাবে দেওয়া যায়, তার জন্য আমরা ঢাকা থেকেও কিছু ইক্যুইপমেন্ট পাঠিয়েছি। এ ছাড়া সিলেটে তো আগে থেকে সেবা নিশ্চিত করার যন্ত্রপাতি আছেই। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিতে প্রস্তুত।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে এক দিন এই ফ্লাইট পরিচালিত হবে। প্রথম পর্যায়ে কেবল শুকনো পণ্য এই ফ্লাইটে পরিবহন করা যাবে। সে ক্ষেত্রে গার্মেন্টস পণ্যই প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করছি।’ 

ডিসেম্বর ঘিরেই ইসির নির্বাচনের প্রস্তুতি

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৯ এএম
ডিসেম্বর ঘিরেই ইসির নির্বাচনের প্রস্তুতি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিস

চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের জুনের মধ্যে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সরকার জানালেও নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তুতি চলছে ডিসেম্বরকে ঘিরে। 

মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) খবরের কাগজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির সিনিয়র সচিব মো. আখতার আহমেদ এবং অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ। এরই মধ্যে সংসদ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের নির্বাচনি সরঞ্জামের চাহিদা নিরূপণে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়ের (বিজি প্রেস) সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কারণ সংস্থাটি মনে করছে সরকার নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করতে পারলে তাদের পক্ষে যেকোনো সময়ই নির্বাচন আয়োজন করা সহজতর হবে। 

বৈঠকের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন উপলক্ষে ব্যালট পেপার, মনোনয়ন ফরমসহ বিভিন্ন নির্বাচনিসামগ্রী ছাপাতে ইসির প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৭০ হাজার রিম কাগজ; যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। যথাসময়ে এসব প্রস্তুত করতে সরকারি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বিজি প্রেসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রস্তুত করাসহ ভোটের জন্য আনুষঙ্গিক ১০ ধরনের সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এবারের সংসদ নির্বাচনে ইসিকে ইউএনডিপির সার্বিক সহযোগিতার পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।

গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচনি সরঞ্জামের চাহিদা নিরূপণে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এবং বিজি প্রেসের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। সভার আলোচ্য বিষয় ছিল- নির্বাচনি কাজে ব্যবহৃত কাগজপত্র কেনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ; মুদ্রণ কার্যক্রম শুরুর সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ; জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট পেপার মুদ্রণের প্রস্তুতি; স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত) নির্বাচনের ব্যালট পেপার মুদ্রণ পরিকল্পনা; সরবরাহ না হওয়া সামগ্রীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিবিধ। সভার লক্ষ্য ছিল- জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যালটসহ যত ধরনের সামগ্রী লাগবে সেসব মুদ্রণে কী পরিমাণ পেপার লাগবে, বাজেট কত হতে পারে এবং কেনাকাটা থেকে মুদ্রণে কত সময় লাগতে পারে এসব যাচাই করা।

পরে সংস্থাটির সিনিয়র সচিব মো. আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে কী পরিমাণ কাগজ লাগবে, এ সংক্রান্ত বাজেটের সংস্থানের ব্যাপার এবং আগের নির্বাচনের কিছু কাগজপত্র বিজি প্রেসে রয়েছে সেগুলোর গুণগত মান নষ্ট হয়ে থাকলে ডিসপোজালের ব্যবস্থা করা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন প্রস্তুতি যেন পিছিয়ে না থাকে সে জন্য কাজগুলো গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। মূলত পেপার প্রকিউরমেন্ট থেকে প্রিন্টিং পর্যন্ত কতটা সময় লাগতে পারে তা জানা। উনারা বলেছেন, ৩ মাস থেকে ৪ মাস সময় লাগবে। নির্বাচনের তারিখ বা নির্বাচনের শিডিউল সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তটা হবে তখন যেন আমাদের ব্যাকওয়ার্ড ক্যালকুলেশনটা থাকে।’ ইসি সচিব জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব কাজের অগ্রগতি জানতে একটি কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৪ মাসের মধ্যে নির্বাচনি সব ধরনের সামগ্রী সংগ্রহ করার ব্যাপারে তারা আশাবাদী।

সংসদ নির্বাচন প্রস্তুতিতে যা প্রয়োজন

গত ২ মার্চ প্রকাশিত ইসির সবশেষ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। অর্থৎ প্রায় সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের জন্য ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ধরনের ফরম, প্রচারপত্র, আচরণবিধি, ম্যানুয়্যালসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ইসিকে ছাপাতে হবে। সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে মোট ৪৩ ধরনের পেপার ছাপাতে হয়। তার মধ্যে রয়েছে- ২১ ধরনের ফরম, ১৭ প্রকার প্যাকেট, ৫ প্রকার পরিচয়পত্র, আচরণবিধি, প্রতীকের পোস্টার, নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়াল, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ও নির্দেশিকা। 

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের বর্তমান আসন সংখ্যা ৩০০। এসব আসনের প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করে ব্যালট ছাপাতে কাগজ ও কালি সংগ্রহ, ফর্ম, প্যাড, ব্যানার, পোস্টার, নির্দেশিকা, রেজিস্টার, হিসাবরক্ষণ খাতা ও অন্যান্য সামগ্রী প্রস্তুতের প্রয়োজন রয়েছে। এসব আসনের নির্বাচন এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত) নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনি সামগ্রীর মুদ্রণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে এসব কাগজ কেনা/সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট পেপার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম ও প্রতীকসংবলিত হয়ে থাকে। এ কারণে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তালিকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পেপার স্বল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রণ করে মাঠ কার্যালয় সমূহে বিতরণ করতে হবে। অন্যান্য ফরম, প্যাকেট, পরিচয়পত্র, আচরণ বিধিমালা, প্রতীকের পোস্টার, ম্যানুয়াল, নির্দেশিকা ইত্যাদি সম্ভাব্য সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মুদ্রণ করে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

সংস্থাটির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা দুই ধরনের তারিখ দিয়েছেন। তবে আমরা প্রথমটা (ডিসেম্বর) ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ আগে প্রস্তুতি থাকলে পরে আমাদের পক্ষে নির্বাচন আয়োজন করা সহজ হবে। আর এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ ও নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনা এবং মুদ্রণের যাবতীয় কাজ ভোটের আগে আগামী ৪ মাসের মধ্যেই শেষ করতে চাই। তবে যে জিনিসগুলো আমরা আগে সংগ্রহ করব তাতে কোয়ালিটিতে কোনো সমস্যা হবে কিনা- যেমন নির্বাচনে ব্যবহৃত কালি; তা শুকিয়ে যাবে কিনা সেসব বিবেচনা করে সময়কাল বিবেচনায় সংগ্রহ করা হবে।’ 

কে এম আলী নেওয়াজ আরও বলেন, সংসদ নির্বাচনে ভোটের জন্য আমাদের ১০ প্রকার সরঞ্জাম প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে- ৩ প্রকার বস্তা, ৩ প্রকার সিল, ব্যালটবাক্সের জন্য লক ও গালা। এই ৮ ধরনের সরঞ্জাম এদেশের বিভিন্ন মার্কেট থেকে কেনা হয়। তবে অমোচনীয় কালি ও স্ট্যাম্প প্যাড- এ দুটি সরঞ্জাম আমাদের বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এবার দেশীয় ধরনের ভোটের সরঞ্জাম কেনায় ইসির বাজেট প্রায় ৯ কোটি টাকা। লোকাল মার্কেটের এসব আইটেম কেনার জন্য গত ১০ এপ্রিল টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। আর অমোচনীয় কালি ও স্টাম্পপ্যাড ইমপোর্ট করতে খরচ হতো প্রায় ৩০ কোটি টাকা; যা এবার ইউএনডিপি আমাদের ইমপোর্ট করে এনে দেবে। এতে আমাদের প্রায় ২০-২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। আর ভোটার তালিকা কার্যক্রমের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ওপরে সহায়তা পাওয়া গেছে। তবে আমাদের মেইন টাকা পয়সাটা লাগবে প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ট্রেনিং, ল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য ফুয়েলসহ অনেক খাতে। এ ছাড়া ট্রেনিং সেন্টার, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট ও অন্যান্য কার্যক্রম যেগুলো আছে সেগুলোতে আমাদের টাকা বেশি লাগবে। সেসব ক্ষেত্রেও আমরা ইউএনডিপির সহায়তা পাব আশা করছি। 

এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইসির নির্বাচনি ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর জাতীয় ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য ইসির এই বাজেট ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি সংসদীয় আসনে ৪৮ হাজার ভোটকেন্দ্র ছিল। এবার সে সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে চলমান হালনাগাদ ভোটার তালিকার তথ্য সংযুক্ত করা সম্ভব হলে এবার ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে হতে পারে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। 

বিজি প্রেসের তথ্য অনুযায়ী, এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনে (ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত) ২ লাখ ৩০ হাজার রিম কাগজের প্রয়োজন হবে। নির্বাচনের আগে এ পর্যায়ে কিনতে হবে ১ লাখ ৭০ হাজার রিম কাগজ। এ জন্য ৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫২৩ টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। বাকি কাগজগুলো বিজি প্রেসের কাছে সংরক্ষিত। এর আগে বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য নির্বাচন উপলক্ষে ২০২৩ সালে কেনা হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ রিম কাগজ।