
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দলটি মনে করছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকারসংশ্লিষ্টদের মতামত এক জায়গায় স্থির থাকছে না। তারা ডিসেম্বর, মার্চ ও জুন- এই তিন সময়কে সামনে এনে একেকজন একেক সময় একেক কথা বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও তার বক্তব্যে কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলছেন না। ফলে ডিসেম্বরে আদৌ ভোট হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
সবশেষ গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাতে খুব বেশি সময় নেই, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এর দুই দিন আগেই গত শুক্রবার ঢাকায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ এখানে ছয় মাস নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সামনে রেখে তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে বিএনপিতে নতুন করে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ দুই বক্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন বিএনপি নেতারা। ডিসেম্বর বা জুনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করারও চেষ্টা হচ্ছে বলে তাদের কেউ কেউ মনে করেন। তারা বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন করতে কত দিন সময় লাগবে সরকারের সে বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা উচিত, তা না হলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও জনগণের দূরত্ব বাড়তে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টা তার কথা রাখবেন এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড।’ অর্থাৎ যদি কোনো জাজমেন্ট দিতে দেরি হয়, তাহলে বুঝতে হবে জজ সঠিক রায় দেবেন না। রায় যদি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন তাহলে বুঝতে হবে, এটা সঠিক রায়। আর যদি রায় না দেন তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যদি সঠিক সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশ ও জনগণ আরও সংকট পড়বে। জনগণের কপালে দুর্ভোগ রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তার সরকার। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জানিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়ে কমিশনের কাজ এগোচ্ছে। সবশেষ গত ১০ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর সময়সীমা পার করতে চায় না ইসি। অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে চায় ইসি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রধান উপদেষ্টার একেক সময়ে একেক বক্তব্যে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
পাশাপাশি ওই বক্তব্যের পরে রাজনৈতিক মহলেও নতুন করে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে, নির্বাচন আদৌ এ বছরের ডিসেম্বরে হবে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবকে কোনো কথা বলা মানে এর তাৎপর্য অনেক বেশি। তারা সন্দেহ করছেন, ডিসেম্বরে ভোট না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ থাকতে পারে। তাই নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ স্পষ্ট করতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন ঠেলতে ঠেলতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। আর পরিস্থিতি এমন হলে আগামী দেড় থেকে দুই বছরে অনেক ঘটনায় দেশের রাজনীতির মাঠে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে।
জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা উপহার পায়। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ দল ভোট বর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু একবারই বিশেষ কারণে জুনে ভোট হয়েছে। জুন-জুলাই মাসে বর্ষা ও গরমের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির কম।
তাই জুন-জুলাইয়ে আগামী নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, গরম ও বর্ষার মধ্যে ভোটাররা ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করেন না। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা থাকে। তাই শীতের সময়টিতে নির্বাচনের জন্য সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব দিক বিবেচনা করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে তা পরবর্তী বছরের অক্টোবরের আগে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকে।
নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব দৃশ্যমান রয়েছে। এ প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর মনোভাব আবার সরকারের কাছাকাছি। এ কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকার ও ছাত্রদের মধ্যে সখ্য দেখছে বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কারণেই বিএনপিতে সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে, সরকার আদৌ নির্বাচন দেবে কি না? এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে চাপে রাখতে এপ্রিলে মাঠের আন্দোলনে যেতে পারে বিএনপি।
জানা গেছে, ঈদের পর এই ইস্যুতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগামী জুন-জুলাই নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময়। সংস্কার-সংস্কার করে নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়োজন নেই। কিছু সংস্কার হয়েছে, বাকিগুলো করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক।’ তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ডিসেম্বরের কথা বলেছেন, আবার বেশি সংস্কারের জন্য পরের বছরের জুনের কথা বলেছেন। তবে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ নির্বাচন চায়। যদি কারও কথায় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, তাহলে দেশের ক্ষতি হবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার আসবে না। আবার যদি এই সরকারের মধ্যে ফ্যাসিস্ট আচরণ জন্ম নেয় তাহলে জনগণ আশাহত হয়ে পড়বে। সে জন্য দ্রুত নির্বাচন দেওয়া জরুরি বলে মনে করি।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে কোন বছরের কোন মাসের কত তারিখে নির্বাচন হবে- তার রোডম্যাপ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো দেয়নি। ফলে সরকারের নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি সরকার ক্ষমতা ছাড়লে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই বিতর্ক করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিলম্ব করলে সরকারের জন্য বিপজ্জনক। দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংশয়ের মূলে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং এনসিপি নেতাদের নানা কথাবার্তা। বিএনপি মনে করছে, সরকার ও ছাত্ররা নির্বাচন হোক এটা চাইছেন না। বিশেষ করে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারসহ কয়েকজন উপদেষ্টা নির্বাচনের বিপক্ষে। ছাত্রনেতারা ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। এ জন্য তারা বৃহৎ সংস্কারের কথা তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন।