
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের কারণে নির্বাচনের আগে সংস্কারের পক্ষে ছিল জনমতও। সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সরকারের একাধিক কমিশন এরই মধ্যে রিপোর্টও জমা দিয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক সুপারিশ নিয়ে অংশীজনরা আপত্তি জানাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এত আপত্তির মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে বা বাস্তবায়ন হবে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংস্কার কার্যক্রম অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আপত্তি আসুক আর যাই আসুক, সংস্কার হতেই হবে। সংস্কার হতে হবে বিশেষ করে এই চারটি খাতে। এই সংস্কার যদি না হয়, তাহলে দেশ টিকতে পারবে না। দেশ এখন যে অবস্থায় আছে, সংস্কার ছাড়া ভালোভাবে পরিচালনা করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার না করে নির্বাচনের মধ্যে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। কারণ একটা নির্বাচিত সরকার আসে, তাদের তো ক্ষমতার ক্ষেত্র একটু কমে যায়। তাদের অনেককে খুশি রাখতে হয়। অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। এই সরকার তো একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে, তারা অনেক কিছু করতে পারে। যেটা নির্বাচিত সরকার পারবে না। তাদের বাধা-নিষেধ আসবে না। নির্বাচিত সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এই সরকারের আমলে সংস্কার হয়েই তারপর নির্বাচন করা উচিত। প্রত্যেকটা জায়গায় হাত দিতে এবং সংস্কার করতে হবে।’
সবার বক্তব্যকে আমলে নিতে হবে জানিয়ে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান খবরের কাগজকে বলেন, সংস্কার এমন একটা জিনিস, যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। সংস্কার তো কোনো বিপ্লব না। সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া যায় না। অংশীজন, রাজনৈতিক দল ও সরকার সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেখানে ঐকমত্য হবে, সেই সংস্কারগুলো করে ফেলতে হবে। বাকি সংস্কারগুলো সংসদ নির্বাচন হলে তখন জনগণের একটা সরকার আসবে, তাদের মাধ্যমে করা হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ১৩টি বিষয়ের ওপর। এ ছাড়া ২২টি আইনের পরিমার্জনের কথাও বলা হয়েছে। তবে অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের চাওয়া নিরপেক্ষ কমিশন বা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। কিন্তু এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকা বা সরাসরি প্রস্তাব না রাখায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এই কমিশনের গঠন, কার্যপদ্ধতি, আইনিভিত্তি নিয়ে আরও পর্যালোচনার মত দেয় কমিশন। বিষয়টিসহ আরও একাধিক বিষয় নিয়ে কথা বলছেন পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও এসব বিষয় সামনে আসে।
অংশীজনদের আপত্তির মধ্যে সংস্কারকাজ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা উচিত। এটা তো কারও বিরুদ্ধে না। আমরা তো সবাই বলি, পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক। পুলিশ স্বাধীন কমিশনের অধীনে কাজ করবে, এটা সরকার একটা কমিশন গঠন করে দিল। কমিশনের ভদ্রলোকেরা (সদস্যরা) ধরি মাছ না ছুঁই পানি, কিছুই করল না।’
পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ ব্যক্তির মতে, এখানে দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। দ্বিতীয়ত, যেসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে এগুলোর নিষ্পত্তি করা।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ তো নিজ থেকে বলছে, আমি যদি ভুল করি আমার শাস্তি হওয়া উচিত। স্বাধীন শক্তিশালী ওয়াচ ডগ থাকবে। কিন্তু এগুলো তো হচ্ছে না। পুলিশকে তো যখন যে দল আসবে তাদের কথামতো চলতে হচ্ছে। সংস্কার এক সরকার করল আরেক সরকার এসে বাতিল করে দেবে। তাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। একটা কমিশন হবে সেখানে সরকারি লোক থাকবে, বিরোধী দলের লোক থাকবে, নিরপেক্ষ লোক থাকবে, সিভিল সোসাইটি থাকবে, সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সেখানে আলাপ-আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। কেউ বাড়াবাড়ি করতে পারবে না।’
অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারদের মধ্যে ব্যাপক আপত্তি রয়েছে। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা কমিশন প্রধানের পদত্যাগেরও দাবি জানান। উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ক্যাডার থেকে নিয়োগ, পদোন্নতিতে পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার হিসেবে না রাখাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষুব্ধ ক্যাডার কর্মকর্তারা। বিসিএস পরিসংখ্যান ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংস্কার কমিশনও ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কিছু অংশ নিয়ে ইতিবাচক মতামত এলেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ অন্য বিষয়গুলোতে রয়েছে আপত্তি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের কথা বলছে। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকেও ভিন্ন অবস্থান রয়েছে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে।
আর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে আপত্তির কথা লিখিতভাবে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এনআইডি কার্যক্রমের দায়িত্ব, নির্বাচনি সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কমিশন গঠনসহ অন্তত ১০টি বিষয় তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইসির বক্তব্য অনুযায়ী, এসব বাস্তবায়ন হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। আগামী ২০ মার্চ আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে সরকার। সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মতামত গ্রহণ করছে। এখনো বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জমা দেয়নি, সময় চেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হবে জুলাই সনদ। বিশ্লেষকদের মতে, সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে।