
কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতির ধীর গতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে অস্বাভাবিক হারে। গত ছয় মাসে তা আরও মন্থর হয়ে এসেছে। সবশেষ গত জানুয়ারি মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে কমছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি। এতে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির তথ্য রয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে কেবল ২০২১ সালে মে মাসে একবার ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে নেমে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছিল। সর্বোচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশে উঠেছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে।
বেসরকারি খাতের ঋণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূলত জুলাই-আগস্ট আন্দোলন শুরুর পর থেকে এ খাতে প্রবৃদ্ধি আরও কমতে থাকে। গত জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সরকার পতনের মাসে (আগস্টে) তা নামে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ; যেটি ছিল তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। নিম্নমুখী এ হার পরের মাসে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে। নভেম্বরে তা আরও কমে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়। ডিসেম্বরে সেটা আরও কমে হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর সবশেষ জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ সময় বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮০ হাজার ১১০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৩৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। আর ছয় মাসে কমেছে ৩৪ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা।
সরকার পতনের পর নতুন নতুন নীতিমালা, ঋণের উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিসহ নানা কারণে বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ এর আগে এতটা মন্থর হয়ে আসতে দেখা যায়নি। নভেম্বরের পরও এ চিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং এখন ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে এরও বড় অংশ এসেছে অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে।
প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা আছে, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছুদিন কারখানা বন্ধ ছিল, শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, এসব কারণে কিন্তু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থায় কিছুটা চির ধরেছে। বিনিয়োগকারীরা প্রথমেই দেখবেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এমন বাস্তবতায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।’
এদিকে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হলেও ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ।
জানা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন গভর্নর তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছেন। এতে ঋণের সুদহারও বাড়ছে। সবশেষ গত জানুয়ারিতে ঋণের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পায়নি। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার খুব বেশি কমতে দেখা যাচ্ছে না।
এই অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের সিংহভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। যদিও মূল্যস্ফীতি না কমে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখন আরও বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ নয়, বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান ডিসিসিআিইয়ের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আছি, তারা বিদ্যমান ব্যবসা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সে চেষ্টা করছি। ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়ার কথা কেউ ভাবছে বলে আমার জানা নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কিংবা কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে সরকার কারও সঙ্গে আলোচনায়ও বসছে না। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া এখন অনেকটাই দুর্লভ বিষয়। আর এত উচ্চ সুদ আর ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে নতুন ব্যবসা করাও অনেক কঠিন। সরকার কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের ওপর চাপ আরও বেড়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায়, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায়, অবকাঠামোগত সুবিধা না বাড়ায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেকদিন ধরেই জিডিপির আনুপাতিক হারে একই পর্যায়ে অর্থাৎ ২২-২৩ শতাংশই রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে সচেতন থাকলেও দৃশ্যমান তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিনিয়োগ স্থবিরতা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হবে না, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও হবে না। ফলে সরকারের যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটাও অর্জন হবে না।’
একই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ‘খুবই ভঙ্গুর’। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির সবই পরস্পর সম্পর্কিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনি একটা সরকারকে বলছেন ইন্টেরিম। এই শব্দটাই তো বিনিয়োগের জন্য অসুবিধাজনক। একজন বিনিয়োগকারী চিন্তা করবে যে এসব অন্তর্বর্তীর পলিসির কী স্থায়িত্ব থাকবে? বিনিয়োগ করতে তারা ভাববেন। রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির একটা গভীর সম্পর্ক আছে।
যদিও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমায় চিন্তিত নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কারণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিনিয়োগের নামে ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। যা এখন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এখন প্রকৃত ব্যবসায়ীরাই ঋণ পাচ্ছেন। তাই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যবসায়ীই নতুন উদ্যোগ নিচ্ছেন না। বরং তারা চলমান কারখানাগুলো চালু রাখার চেষ্টা করছেন। এটা যদি আরও কমে তাতেও সমস্যা নেই। কারণ প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ নিতে পারবেন।