
এবারও ঈদকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকা তৈরির চক্রগুলো। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে তৎপরতা চালাচ্ছে এসব চক্র। চলতি মাসে এরই মধ্যে ঢাকার বেশ কয়েকটি শপিংমলে জাল নোট পাওয়া গেছে। বাজারে ছড়িয়ে পড়া এসব জাল নোটের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই ঈদের সময় এবং বিভিন্ন উৎসব ঘিরে জাল নোট তৈরির এসব চক্র তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বাড়তি নজরদারি করেন। এবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিপণিবিতান, শপিংমল, বাজার এলাকায় জাল নোট চক্রের তৎপরতা রোধে নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দারা। ওই সব স্থানে সাদা পোশাকে, ক্রেতাবেশে আবার প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সন্দেহজনক বিষয়ে গোয়েন্দারা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাল নোট পেয়ে প্রতারিত হওয়া একাধিক ব্যবসায়ী খবরের কাগজকে বলেন, এমনিতে ব্যবসা খুব একটা ভালো না। তার ওপরে চুরি-ছিনতাই লেগেই আছে। এরপর যদি বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে পরে তবে না দোকান ভাড়া দিতে পারব; না কর্মচারীর বেতন দেওয়া যাবে। ঈদে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
সম্প্রতি জাল নোট পেয়ে প্রতারিত হওয়া গাউছিয়া মার্কেটের নূর ম্যানশনের রনি কালার কসমেটিকস অ্যান্ড জুয়েলারি দোকানের মালিক রুহুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাতে গোনা সামান্য কামাই করি। তাই দিয়ে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ করতে হয়। তার ওপরে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন। এরপর যদি আবার জাল নোট হাতে চলে আসে, তাহলে ব্যবসার মূলধন ও লাভ সবশেষ; পথে বসতে হবে।’ তিনি জানান, গত রবিবার রাতে দোকানে বেচাকেনার পর রাতে হিসাব মিলাতে গিয়ে দুটো ৫০০ টাকার জাল নোট ধরা পড়ে। তিনি জাল নোট রোধে ব্যবস্থা নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, অভিযোগ না পেলে পুলিশ আসে না। এ ছাড়া জাল নোট নিয়ে ধরা পড়লেও তারা জামিনে বেরিয়ে যান, আর সাজা বলতে নামমাত্র; তাই এই অপরাধ বেড়ে চলেছে। সরকারের উচিত কেউ যেন জাল নোট তৈরি করতে না পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
গত শুক্রবার ঈদ কেনাকাটা করতে গিয়ে জাল নোট পেয়েছেন ধানমন্ডির বাসিন্দা রিপন আশরাফ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটা করতে নিউ মার্কেটের একটি দোকানে গিয়েছিলাম। ভিড়ের মধ্যে অনেক কষ্টে কেনাকাটা শেষ করি। পরে বাসায় ফিরে ২টি ৫০০ টাকার জাল নোট শনাক্ত করি।’
জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক রমজানের আগে জাল নোট প্রতিরোধে বেশকিছু সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জাল নোট শনাক্তকরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় জাল নোট শনাক্তকরণের নিয়মাবলী সংক্রান্ত পোস্টার এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যাতে সব গ্রাহক দেখতে পান। ২৪ রমজান থেকে বড় বড় শপিংমলে জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ব্যাংকে যদি গ্রাহকের হাতে জাল নোট ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রাহক যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে জাল নোট জমা দেন, তাহলে তার নাম ঠিকানা লিখে রেখে ছেড়ে দেয়। আর যদি বুঝতে পারে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করছে তাহলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাল নোট প্রতিরোধে ডিএমপির ডিবি, সিটিটিসি ও ইউনিফর্ম পুলিশ কাজ করছে। এ ছাড়া জাল নোট চক্রের তৎপরতা ঠেকাতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, কেনাকাটার পরে অবশ্যই টাকা দেখে নিতে হবে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা সচেতন হলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে।
চলতি মাসের প্রথম দিকে বাংলামোটর শাখার আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের এক নারী গ্রাহক ৫০ হাজার টাকা টাকা জমা দিতে এলে দুটি ৫০০ টাকার জাল নোট মেশিনে শনাক্ত করা হয়। ওই নারী ব্যাংক কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক বলেন, তার এক আত্মীয়র কাছ থেকে টাকা পেতেন। সেই টাকা পেয়ে এই ব্যাংকে জমা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু ভেতরে যে জাল টাকা আছে সেটি তিনি বুঝতেও পারেননি।
গত ১৩ মার্চ কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে ২০ লাখ টাকার জাল নোট, আংশিক প্রিন্ট করা ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার জাল নোট ও জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। এরপর গত ১৭ মার্চ রাজধানীর ওয়ারীতে অভিযান চালিয়ে টাকা ও রুপির জাল নোটসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।