
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে সরকার। গত আট মাসে (জুলাই ২০২৪-ফেব্রুয়ারি ২০২৫) পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ৫৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। এত বড় ঘাটতিতেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে এনবিআর জোরালো আপত্তি জানিয়েছে। তবে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে সূত্র জানিয়েছে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) এসব তথ্য জানা গেছে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এ সময়ে এনবিআরে আদায় হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৭১ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনবিআরের আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত এনবিআরও। রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলা ও আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য এরই মধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর কর বাড়িয়েছে সংস্থাটি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি না ফেরা এবং বেশ কিছু নিত্যপণ্য আমদানিতে ছাড় দেওয়ায় সরকারের রাজস্ব কমেছে। একই সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মন্দাভাব থাকায় চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে যাওয়া কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়াকেও রাজস্ব কমার কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআরের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। এ ধারা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে এনবিআরের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে এনবিআরের ওপর লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা ঠিক না।’
আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে আপত্তি জানিয়ে এরই মধ্যে এনবিআর থেকে অর্থ বিভাগের সচিবকে এক চিঠি পাঠিয়ে লক্ষ্যমাত্রা কমানোর আবেদন করা হয়েছে। এ চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সতর্ক করে বলেছেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। না হলে আগের বছরের মতোই লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণ থাকবে, আর দায় চাপানো হবে এনবিআরের ওপর। অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তা অর্জনে ব্যর্থতা এনবিআরের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ পরিস্থিতি এড়াতে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার প্রকৃত সংগ্রহের তুলনায় ১৫ শতাংশ রাখতে হবে।’
এই প্রথম কোনো এনবিআর চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিক ‘অবাস্তব’ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন। সরকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে খানিকটা বেকায়দায় আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে আগামী তিন অর্থবছরের ২০ লাখ ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের জন্য বলেছে। এর মধ্যে শুধু এনবিআরের আওতায় আদায়ের পরিকল্পনা ১৮ লাখ ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিতে এই বড় পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর থেকে রাজম্ব আদায় বাড়াতে ইটিআইএনধারী এবং অনলাইনে রিটার্নের সংখ্যা বাড়ানোর কাজ করছে। অনলাইনে রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সমগ্র রাজস্ব আদায়ের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। এসব উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আগামীতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে এনবিআর থেকে জানানো হয়েছে।