
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত ১০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমেও সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব, অতীতে বাংলাদেশে এটা হয়েছে।’ তার এই বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টসহ আইন অঙ্গন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের একটি বক্তব্য আবার সামনে এসেছে। গত নভেম্বরে দেওয়া ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধ্যাদেশ আকারে সবকিছু করা যাবে, শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ মার্চ অধ্যাপক আলী রীয়াজ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ কথার মাধ্যমে আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত চার বছরের সব প্রোক্লেমেশনকে বুঝিয়েছি। যার কয়েকটি সংবিধানের পরিবর্তন বিষয়েও ছিল। এগুলো পরবর্তী সময়ে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হয়।’
ওই সময় সংবিধান বহাল ছিল না। এখন সংবিধান বহাল আছে। সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন নিয়ে আইন অঙ্গনে ভিন্নমত আছে। বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘তখনকার বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হয়। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে সংসদ থেকে এটিও সংবিধানে গৃহীত হতে সমস্যা হওয়ার কথা না।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য টুইস্ট করা হয়েছে। মিডিয়া মনগড়া হেডলাইন দিয়ে আমার বক্তব্য প্রকাশ করেছে। তাই আমি কোনো বিষয়েই কোনো মিডিয়াকে বক্তব্য দেব না। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি।’
আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার নাকি পুনর্লিখন হবে, এই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে উনাকে (আলী রীয়াজ)। কিন্তু এই কমিশন করার আগেই উনি সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে উনার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ থাকার কারণে তাদের মতামত শুনছেন। তাই উনারা কী বলছেন, সেটি অত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কিছু নেই। আশা করব মিডিয়াও উনাদের কার্যক্রম অত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রথমে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে তা পরিবর্তন করে গত ৭ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আলী রীয়াজের দেওয়া গত ১০ মার্চের ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমি গণমাধ্যমে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না। এখনো দেব না।’
এ বিষয়ে রিটায়ার্ড জাজেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা যায় না। অতীত উদাহরণ দেখিয়ে অধ্যাদেশের মাধ্যমে যদি সংবিধান সংশোধন করা হয় বা আইন সংশোধন করা হয়- যাই করা হোক না কেন, তা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে করতে হবে। না হয় পরবর্তী সংসদ যদি তা পাস না করে, তাহলে তো সব অর্থহীন হয়ে যাবে।’
ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম মিয়া বলেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। শুধু আইন সংশোধন করা যাবে। তাও যদি তা জনস্বার্থে হয়। সুতরাং যা করা হচ্ছে, তা যে জনস্বার্থে করা হচ্ছে, এই বিষয়টিও নিশ্চিত হতে হবে।’
উল্লেখ্য সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘[সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত] কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, যাহাতে এই সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত বা রহিত হইয়া যায়।’
প্রসঙ্গত গত ১০ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চায় কমিশন।
সম্মেলনে আলী রীয়াজ জানান, সংস্কারের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামত চেয়েছে কমিশন। দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর শুরু হবে আলোচনা। আলোচনার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সে সময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে।
সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতি যত দ্রুত সম্ভব মতামত জানাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে।’
এদিকে গত ১৬ নভেম্বর ‘কেমন সংবিধান চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে আইন, বিচার, সংবিধান ও মানবাধিকারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে, যাদের রক্তের বিনিময়ে এখানে দাঁড়িয়ে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে, এটা তাদের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা জানানো। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও চিন্তায় রাখতে হবে। কারণ, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আছি বলে মনে হয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই প্রস্তাবগুলো বর্তমান সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারবে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধ্যাদেশ আকারে সবকিছু করা যাবে। শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া।’