
ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা থাকলেও বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছেন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, নির্বাচন সামনে রেখে এই বক্তব্যের নানামুখী তাৎপর্য রয়েছে। তারা বলছেন, তারেক রহমান নিজে ‘কথার কথা’ হিসেবে এই বক্তব্য দেননি। বরং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই এই বক্তব্য দিয়েছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব বিবেচনায় নেওয়ার পাশাপাশি দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য এমন কথা বলেছেন।
গত বুধবার এক ইফতার মাহফিলে তারেক রহমান বলেন, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অপতৎপরতা ও চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হলে তাদের সঙ্গে নিয়ে পরাজিত অপশক্তি দেশে ফের গণতন্ত্রের কবর রচনা করবে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ নতুন করে আলোচনায় আসছে। বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙা, একটি জাতীয় দৈনিকের সামনে গরু জবাই করে ‘জিয়াফত’ নামে খাবারের আয়োজন করা, নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের মিছিল এবং তৌহিদি জনতার নামে ইসলামপন্থিদের তৎপরতা বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েন থাকায় সে দেশের মিডিয়াও এসব ঘটনা সামনে নিয়ে আসছে। ছড়ানো হচ্ছে অপতথ্যও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, এক্সেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। দেশে এমন আলোচনা ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে- দেশ আবার ডানপন্থিদের হাতে চলে গেল কি না। আদর্শিক ও নীতিগত কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের বিরোধও স্পষ্ট হয়েছে।
অনেকের মতে, বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাগুলোর সূত্র ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড এসব কথা বলার সুযোগে পেয়েছেন। বিএনপি এবং তারেক রহমান মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকলে একদিকে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে; যাতে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ‘উগ্রবাদে’র ট্যাগ দেওয়া হতে পারে বলে বিএনপি মনে করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, যেকোনো ধরনের উগ্রবাদ, চরমপন্থা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে উগ্রবাদ বা চরমপন্থা রাজনীতির প্রধান ধারা নয়। এগুলো হচ্ছে রাজনীতির মধ্যে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন ধারা। তবে তাদের কণ্ঠস্বর অনেক উঁচু এবং তাদের কথা বেশি শোনা যায়। সে জন্য তাদের একটা প্রবল শক্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় চরিত্র হচ্ছে মডারেশন বা মধ্যপন্থা। এখানে সেই ধরনের তৎপরতা বাড়ার আশঙ্কা নেই। যদি করতে থাকে, সেটাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা উচিত। সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা উচিত।
তারেক রহমানের এই বক্তব্য দেওয়ার কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রথমত এখানে ভারতের একটা ডিজাইন আছে। তুলসী গ্যাবার্ড আসার পর নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাকে নিয়ে একটা কনট্রোভার্সি বা বিতর্ক হয়েছে। বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনও নাকি উদ্বিগ্ন। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ক্রমান্বয়ে প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছে ভারতের মিডিয়া। বাংলাদেশে উগ্রবাদীরা ব্যাপক সক্রিয় প্রমাণ করতে পারলে দুটি দেশের (ইউএসএ ও ইসরায়েল) শর্তহীন সমর্থন পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে ইসলামি শক্তির একটা তৎপরতা বেড়েছে। তার জন্য ভারত চিন্তা করে, তাদের আশপাশে মুসলমান আছে। পশ্চিমবঙ্গে এবং আসামে। মাঝখানে বাংলাদেশ। এ জন্য তারা মনে করে, এখানে তাদের সমস্যা হতে পারে।’
দ্বিতীয়ত, বিজেপির মধ্যে একটা চিন্তা আছে। তৃতীয়ত, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব চলছে। এটাও একটা কারণ।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক খবরের কাগজকে বলেন, উগ্র ধর্মবাদে তো গণতন্ত্রের স্থান নেই। মুসলিম মৌলবাদ যদি বলেন, আফগানিস্তান, ইরানে যার উদারহণ আছে। এসব দেশে তো পশ্চিমা অর্থে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রকে তো তারা বিশ্বাস করে না। আলেম-ওলামারা মজলিসে শুরার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করবেন। আমার মনে হয়, ওই অর্থেই বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র হলো ২০০ বছরের ব্যাপার। তার আগে গণতন্ত্র তো কোথাও ছিল না। তার আগে যে সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল, সেটা তো গণতান্ত্রিক ছিল না। যদি পুরোনো চিন্তাতেই দেশ চলে, সেটায় তো গণতন্ত্র থাকবে না। আমার মনে হয়, তারেক রহমান ওই অর্থে বলেছেন। আগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাট ছিল, সেখানে তো গণতন্ত্র ছিল না। তারা যদি বলেন, মুঘল সাম্রাজ্য যেভাবে চলছে, সেটা ভালো ছিল, আমরা সেভাবেই দেশ চালাব। তাহলে স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রের স্থান চলে যায়।’
অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব ধর্মীয় উগ্রবাদ দেখতে চায় না। সাম্প্রতিক সময়ে তুলসীর বক্তব্য থেকে এ রকম আভাস পাওয়া গেছে। যদিও তুলসীর বক্তব্যটা নিজ থেকে ছিল না, প্রশ্নের উত্তরে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।
বিএনপি সব সময়ই ‘ডানের বামে এবং বামের ডানে’ এমন অবস্থান স্পষ্ট করে বলছে, তারা মধ্যপন্থি দল। দলটির নেতাদের ভাষায় বিএনপি একটি ‘আধুনিক মধ্যপন্থি দল’। ফলে দলটি কিছুতেই মৌলবাদ বা উগ্রপন্থার দায় নিতে রাজি নয়। দলটির নেতাদের পাশাপাশি শুভান্যুধায়ীরা মনে করেন, জামায়াত ও ইসলামপন্থিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে গত ১৭ বছর তাদের ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর পরই বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। কিন্তু দলটি তখন ওই ঘটনার তাৎপর্য ঠিকমতো বুঝতে পারেনি বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন।
নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ছিল পৃথিবী থেকে মৌলবাদকে নির্মূল করা। এ জন্য তারা মধ্যপ্রাচ্যে, আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছে। ইরাকে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েল ও গোটা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনের পাশাপাশি ওই ঘটনার পর ভারতকে তারা মিত্র হিসেবে পায়। আর ভারতের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগ তখন এর সুবিধা লাভ করে এবং বিনা ভোটে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ লাভ করে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, নাইন-ইলেভেনের তাৎপর্য বিএনপি বুঝতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু একই সময়ে ভারত এবং আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উগ্রবাদ নিয়ে মিত্র হয়। যে কারণে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। একই সময়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও হেফাজতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। চারদলীয় জোটের সময় বিএনপিকে ধর্মান্ধতার ট্যাগ দেওয়া হয়। জামায়াত থাকায় স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগও দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটের রাজনীতির কারণে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়েনি। ৫ আগস্ট নতুন বাস্তবতায় বিএনপি সবদিক রক্ষা করে ক্ষমতায় যেতে চায়। তাই বিএনপি ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হতে পারে, এ রকম কর্মকাণ্ড বা পলিসিতে যাবে না।
সার্বিক বিষয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা একটা চাপ হিসেবে আসছে। সরকারকে কঠোর বিধিবিধান করতে হবে ধর্মীয় উগ্রপন্থা নিয়ে, যা আইন আছে তার প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা অনেক শক্তিশালী। এনএসআই, ডিজিএফআই, সিআইডিকে কাজে লাগাতে হবে। তারা যদি কাজ করে তাহলে ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমাদের দেশের জন্য জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ খুবই ক্ষতিকর। ইসলামের নামে তারা জঙ্গিবাদ করে, যেটা খাঁটি ইসলাম নয়।’