
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কয়েকটি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি বড় খেলাপির কাছেই আটকে রয়েছে মোটা অঙ্কের ঋণ। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি মাত্র কয়েকটি ব্যাংকেই রয়েছে খেলাপি ঋণের সিংহভাগ। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৭০ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে। খেলাপি ঋণে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে রয়েছে মোট খেলাপির ৫০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে’ এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনটি সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্য নিয়ে করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্যও প্রকাশ করেছে। সেখানে খেলাপি ঋণের আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে যা বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। এটা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে কয়েকটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যার বেশির ভাগই এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশনের পরিমাণ বাড়ে। এটা যদি মুনাফা থেকে মেটানো না যায়, তাহলে মূলধনের ওপর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ মূলধন কমে যায়। তখন ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো ডিভিডেন্ড দিতে পারে না। ফলে শেয়ারের দাম কমে যায়। খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম কার্যকর হলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে, যা ৩০-৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি বা প্রায় ৫১ শতাংশ। বাকি ৫৬টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের কম বা ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে খেলাপি ঋণের শীর্ষে ১০ ব্যাংকে রয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৭০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বাকি ৫১টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী, ঝুঁকি কমাতে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ তাদের মোট ঋণের ৫ শতাংশের কম থাকতে হবে। এর বেশি থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত করা হয়। এদিকে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি হলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের দিক থেকে ৪১ ব্যাংকই ঝুঁকিতে, বর্তমানে ৫০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৭টি ব্যাংকে। আলোচ্য সময়ে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮২ শতাংশই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। ফলে এসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম।
এদিকে সম্পদের গুণগত মান কমার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত হারে এ সম্পদ বাড়ায় এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (এআরএআর) বা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কমপক্ষে ১৬টি ব্যাংক। যদিও জুন প্রান্তিক শেষে এমন ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ১১টি। এতে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে এআরএআর ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে অন্তত ১০ শতাংশ এআরএআর রাখতে হয়।
এআরএআর একটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা পরিমাপ করে, যেখানে মূলধনকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এটি নিশ্চিত করে যে, ব্যাংক সম্ভাব্য ক্ষতি সামাল দিতে এবং আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক এআরএআর ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমেছে, যা জুন প্রান্তিক শেষে ছিল ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর বিপরীতে প্রভিশন বেশি রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেটের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে এসব অ্যাসেট ব্যাংক খাতের পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেটি আদতে মূলধনকে কমিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের পাশাপাশি সম্পদও গুটিকয়েক ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর শেষে মোট সম্পদের ৩১ দশমিক ৩৯ শতাংশ শীর্ষ ৫ ব্যাংকের হাতে রয়েছে। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৪৬ দশমিক ১০ শতাংশ সম্পদ। মূলত এই কয়েকটি ব্যাংকেই গ্রাহকের আস্থা বেশি। ফলে এসব ব্যাংকে সম্পদের পরিমাণও বাড়ছে।
আগে বছরে একবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এটি তিন মাস অন্তর প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাতের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ঝুঁকির মাত্রা ও এগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়।