
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার জোর প্রস্তুতি চলছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিষয় বিনিময়, ভিসা সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশ। এ লক্ষ্যে প্রায় ১৩ বছর পর ফের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসতে যাচ্ছে দুই পক্ষ। আলোচনার বিভিন্ন দিকনির্ধারণ করতে তিন দিনের সফরে আজ ঢাকায় আসছেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচ। এরপর আগামী ২২ এপ্রিল তিন দিনের সফরে আসবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এই সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইসহাক দারের সফরের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৩ বছর পর উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের দ্বার খুলছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের সংলাপ হয়েছিল। এবার উভয় দেশ ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং সম্পর্ক উন্নয়নের চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই এই সংলাপ হচ্ছে।
পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন খান খবরের কাগজকে জানান, ইসহাক দারের আসন্ন ঢাকা সফরকে বাণিজ্য, কূটনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে দুই দেশ। তার সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার পথ খোঁজা হবে।
ইকবাল হোসেন জানান, এই সফরের এক দিন আগেই ঢাকায় পৌঁছাবে পাকিস্তানের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী একবছরে অন্তত ১০টি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের টার্গেট হচ্ছে, বাংলাদেশে তাদের রপ্তানি ৬২৭ মিলিয়ন (৬২ দশমিক ৭ কোটি) ডলার থেকে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারে উন্নীত করা। আর বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তানে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬১ মিলিয়ন ডলার। তবে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং স্বাস্থ্য খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আলোচনায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন স্থগিত থাকা যৌথ কমিশন পুনর্বহাল করতেও প্রস্তাব দিতে পারে পাকিস্তান। এই কমিশনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের নতুন অধ্যায় শুরু হবে। এ ছাড়া সফরকালে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এর ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব নতুন মাত্রা পেতে পারে। দীর্ঘদিন পর এই সংলাপ দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ৫৩ বছরের অমীমাংসিত বিষয় আছে। তবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমরা যদি ওই ইস্যুগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে আমাদের কোনো লাভ হবে না। ওদেরও কোনো লাভ নেই। আমরা অবশ্যই আমাদের স্বার্থ রক্ষা ও উদ্ধারের চেষ্টা করব। পাশাপাশি আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হিসেবেই দেখতে চাই।’
এদিকে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমানযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৭ বছর বন্ধ থাকার পর বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার সরাসরি ফ্লাইট শুরুর ব্যাপারে একমত হয়েছে। পাকিস্তানের ‘ফ্লাই জিন্নাহ’ নামে একটি এয়ারলাইনসকে ফ্লাইট চালুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। শিগগিরই এই রুটে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হবে বলে জানান হাইকমিশনার ইকবাল হোসেন খান। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম-করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচলও বন্ধ ছিল। এ সময় পাকিস্তানের কোনো পণ্য বাংলাদেশে আনতে হলে তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে আনতে হতো। গত ৫ আগস্টের পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরাসরি জাহাজ চলাচল ফের শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে করাচি থেকে দুটি জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে। ফলে আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুতে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য হাসিনার প্রশাসনের ওপর দিল্লির তীব্র প্রভাবও ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগ কোন পন্থায় হবে, সেটাও ভারত থেকে ঠিক করে দেওয়া হতো বলে অভিযোগ আছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক করতে চায় বাংলাদেশ। উভয় দেশই যেন ‘উইন উইন সিচ্যুয়েশনে’ থাকে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে ঢাকা।