
প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে। অভিযোগের অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে গত ৮ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক আহসানুল কবির পলাশের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ওই টিমের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়েছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মোস্তফা কামাল ও তার পরিবারের সব সদস্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করতে আদালতে আবেদন করার উদ্যোগ নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। অবশ্য গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী ও গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি আক্তার এবং সন্তানদের ৩১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ৩০ দিনের জন্য ফ্রিজ করা হয়েছে। তবে অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ রাখার আদেশ চেয়ে শিগগিরই আদালতে আবেদন করবেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের একাধিক অনুসন্ধানকারী টিম কিছু দিন ধরেই কাজ করছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ অন্যতম। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মেঘনা গ্রুপের কর্ণধার মোস্তফা কামাল ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩১ কোটি ৩৩ লাখ ২১ হাজার ১২৬ টাকার শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের পণ্য আমদানি করেছেন। তবে এ সময়ে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) অনুযায়ী ইনভয়েস মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ৪২ লাখ ৪২ হাজার ৩১১ টাকা। সে হিসাবে আমদানির আড়ালে অতিরিক্ত সুবিধা নিয়ে গোপনে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৫ টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৩ মার্চ কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তের পর গত ৮ এপ্রিল দুদক উপপরিচালক আহসানুল কবির পলাশের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়। টিমের অপর ২ সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক ও উপসহকারী পরিচালক নিজাম উদ্দিন।
দায়িত্ব পেয়েই অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠান। ইতোমধ্যে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। চলতি মাসেই সব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হতে পারে। সব তথ্য হাতে পেলে অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ রাখতে আদালতে আবেদন করবেন দুদক কর্মকর্তারা। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম।
মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে অবৈধভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিভিন্নভাবে কর ও রাজস্ব ফাঁকি, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। গত ১৬ বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও নানাভাবে অভিযোগ উত্থাপন হলেও কোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকারি দপ্তর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অর্থপাচার ও বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল। মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, অবৈধ দখলে নদী ভরাট করে নষ্ট করেছেন নদীর গতিপথ। বেসরকারি ৯টি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যার বেশির ভাগই ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর মেঘনা গ্রুপের নানাবিধ দুর্নীতির বিষয়ে দুদকে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে।
মোস্তফা কামাল ও তার প্রতিষ্ঠান শিশুখাদ্য বেশি দামে আমদানি করে শুল্কায়নের সময় কম মূল্য দেখিয়ে একদিকে সরকারের শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে সেই টাকা পাচার করেছেন মর্মেও দুদকে একাধিক অভিযোগ আসে। অভিযোগে বলা হয়, এসব দুর্নীতি ও অপকর্মের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের কর্মীর মতো আচরণ করেছেন তিনি। সে সময় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও বাধা সৃষ্টি করেন মোস্তফা কামাল।
পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে গত ডিসেম্বরে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন নতুনভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে একাধিক বিশেষ অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
২০১৩ সাল থেকে গ্রুপটির আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে আমদানি কমে যাওয়ায় সে বছর স্বাভাবিকভাবে এর পরিমাণ কমে। ২০২০ সালে এলসি ও শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের পার্থক্য ছিল ২৬৪ কোটি টাকা। অথচ এর আগের ৩ বছর এর পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় শুল্কহার সাড়ে ২৯ শতাংশ। হুন্ডিতে দায় শোধ করায় ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি খরচ হয় আমদানিকারকের। ফলে সাড়ে ২৯ শতাংশ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে হুন্ডির পেছনে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ খরচ হলেও রাষ্ট্রকে একটি বড় অঙ্কের টাকা ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৬০ থেকে ৭০টি নৌযান ও প্রায় ১২০০ মোটরযানের বিপরীতে বিমা পলিসি বাধ্যতামূলক থাকলেও পলিসির ৩০০ কোটি টাকা মোস্তফা কামাল আত্মসাৎ করেন। ব্যাংক কমিশনের ৬৩৮ কোটি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৬৩০ টাকা এবং বীমা পলিসির বিপরীতে ৪ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটির ২৫ কোটি ৫২ লাখ ৪১ হাজার ৩০৫ টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করে মেঘনা গ্রুপ। ভ্যাট হিসেবে ব্যাংক কমিশনের ১৫ শতাংশ টাকা পাওয়ার কথা রাষ্ট্রের। ভ্যাটের অন্তত ৯৫ কোটি ৭১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮৪ টাকা লোপাট করেছে গ্রুপটি। রাষ্ট্রের ভ্যাট ও স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৪০৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে।
ঋণ জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ৯টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মেঘনা গ্রুপ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাংক এশিয়া, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এ ছাড়া, মোস্তফা কামালসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। এসব সম্পদের অধিকাংশনই তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
মোস্তফা কামাল মেঘনা গ্রুপের পাশাপাশি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিরও চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময়ে উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন মো. জাকারিয়া ও তার ভাই এম এফ কামাল। পরে পরিচালক হন তাদের বোন বিউটি আক্তার ও বিউটির স্বামী মোস্তফা কামাল। ২০০০ সাল পর্যন্ত বীমা কোম্পানিটি ব্যবসা কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনা করলেও পরে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল।