
সরকারের ব্যাংকঋণের নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় আবার বাড়ছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার। অর্থাৎ সরকারের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকগুলোর জোগান কমে যাচ্ছে। এতে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেড়ে আবার ১২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। এক মাসের ব্যবধানে ট্রেজারি বিলের সুদের হার বেড়েছে ১০১ থেকে ১২৩ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে অর্থবছরের শেষ সময়ে সরকারের ব্যাংকঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে রাজস্ব ঘাটতিও কমানো যাচ্ছে না। ফলে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও বাড়ছে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ায় পর্যায়ক্রমে ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও কমবে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও খুব দুর্বল। যা বর্তমানে তলানিতে নেমে গেছে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগে আরও স্থবিরতা দেখা দেবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে, তাতে সুদহার না বাড়িয়ে উপায় নেই। সবশেষ ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার হয়েছে ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যেখানে ব্যক্তি খাতে ঋণ বিতরণ করে গড়ে ১২ বা ১৩ শতাংশ সুদহার পায় ব্যাংকগুলো। তাহলে ব্যাংকগুলো কেন ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তি খাতে ঋণ দেবে? তিনি বলেন, সরকার রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে ঘাটতি কমাতে পারছে না। বিদেশি সহায়তাও কাঙ্ক্ষিত হারে আসছে না। এ অবস্থায় সরকারের সামনে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে বিশেষ করে ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে বিকল্প কোনো উপায় নেই। তবে ভালো দিক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি টাকা ছাপিয়ে তা আর বাজারে দিচ্ছে না। এটা করলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমে যাবে।
সরকারের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকগুলোতে অর্থের জোগান বেশি থাকায় ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ট্রেজারি বিলের সুদহার অনেকটাই কমে ১০ শতাংশে নেমেছিল। তবে পরের মাস এপ্রিলে তা আবার বেড়ে গেছে। সবশেষ গত সোমবারের নিলামে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। মার্চে যা ছিল ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে সুদহার কমেছে ১২৩ বেসিস পয়েন্ট। এদিন ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এক মাস আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সে হিসাবে সুদহার কমেছে ১০১ বেসিস পয়েন্ট। এপ্রিলে এসে ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে যা ছিল ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সুদহার কমেছে ১১৫ বেসিস পয়েন্ট।
ট্রেজারি বিল হচ্ছে একটি স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্র, যা সরকার জারি করে। সাধারণত এগুলো এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। নিরাপদ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেও ট্রেজারি বিল পরিচিত। কারণ এর ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। আর ট্রেজারি বন্ড হলো দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ঋণপত্র। এটির বিপরীতে বিনিয়োগ থেকে সরকার অর্থ নিয়ে থাকে। এটির মেয়াদ হয় ২ থেকে ২০ বছর। ট্রেজারি বিল ও বন্ড সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি কিনতে পারেন। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ব্যাংকগুলোর কাছে কী পরিমাণে তারল্য রয়েছে সেটির ওপর ভিত্তি করে। সরকারের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য জোগান বেশি থাকলে সুদের হার কমে। আর চাহিদার তুলনায় তারল্য জোগান কম থাকলে সুদের হার বাড়ে।
ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, মাঝখানে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেশ কিছুটা কমে গিয়েছিল। এখন তা আবার বাড়ছে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের চাহিদা বাড়ার কারণেই মূলত ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এর ফলেও ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, সামনে সরকারের আরও বেশি ব্যাংকঋণ দরকার হবে। সে কারণে ব্যাংকগুলো নিলামে উচ্চ সুদ চাচ্ছে। মূলত এ কারণেই ট্রেজারি বিলের সুদের হার কমে তা আবার বাড়া শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমার কথা বললেও এখন তা কিছুটা বেড়ে গেল। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ খাতে সুদ কমার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলোর নিশ্চিত মুনাফা অর্জনের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুদহার কমায় এ খাতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো আর উচ্চ হারে মুনাফা পাবে না। গভর্নরের এই বক্তব্যের প্রায় এক মাস পর আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে বলেন, ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমাতে গভর্নর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি এখনো খুব বেশি কমছে না। আবার রেপোতেও একটু কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ফলে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ছে। এ ছাড়া আমানতের প্রবৃদ্ধিও খুব বেশি বাড়ছে না। তারপরও ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। এ কারণেই মূলত ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ছে। তবে মূল্যস্ফীতি যদি কমে ৭ শতাংশে নেমে আসে, তাহলে আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমে যাবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ৯৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করেছে। ফলে আলোচ্য সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা।