
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রশ্নে- শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে জড়িত দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। গত শুক্রবার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে দ্বিমত আরও স্পষ্ট হয়েছে। শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন।’ তার এই বক্তব্যে দলগুলোর মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট জামায়াতের মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরে করতে হবে। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল জামায়াতের আমিরের বক্তব্য সমর্থন করে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বিএনপি অবশ্য প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পরে চাইছে। দলটি মনে করছে, স্থানীয় নির্বাচন করতে গেলেই জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য এ বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে বলেও তারা মনে করছে। তাদের সন্দেহ, এর পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জামায়াতে ইসলামী অনেক কিছু চাইতে পারে। তারা পাকিস্তান চাইলে কি তা মানতে হবে? অনেকে অনেক কিছু চাইতে পারে, কিন্তু সবকিছু বাস্তবায়ন সম্ভব না। তিনি বলেন, অতীতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কখনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়নি। নির্বাচিত সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করেছে। সুতরাং তারা (জামায়াত) কী চাইল, এটা নিয়ে মাথা খারাপ করার কিছু নেই। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জনগণ মানবে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তোড়জোড় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এতে হয়তো কিছু দল ও ব্যক্তি বেনিফিশিয়ারি হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চাই। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে ভোট ভালো হবে না। কারণ সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের এখনই মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যাপারেও আমরা সন্দিহান। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে জনগণের ভরসা কমে যাচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ময়মনসিংহ নগরীর সার্কিট হাউস ময়দানে কর্মী সম্মেলনে জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একটা নির্বাচন কমিশন হয়েছে। তারা বলছেন, তারা নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দেবেন। আমরা তাদের একটি অ্যাসিড টেস্ট দেখতে চাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দিন। আমরা দেখি আপনাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা কতটুকু। এটার প্রমাণ আপনারা পেশ করুন।’
সমর্থন ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের
জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ। ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই খবরের কাগজকে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাইয়ে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে দেওয়া উচিত। এতে পরীক্ষা হয়ে যাবে, এ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হতে পারে? অতীতে নির্বাচনে গণ্ডগোল, মারামারি হয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচন দেশের জনগণ আর দেখতে চায় না। নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে সব দলকেই এগিয়ে আসতে হবে।’’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে- এ দাবি এখন অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের। একক কোনো দলকে সরকার বিশেষ কোনো সুবিধা দিলে তা দেশের জনগণ বরদাশত করবে না। বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়নি।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনো স্পস্ট রোডম্যাপ ঘোষণা হয়নি। এ ছাড়া সারা দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় জনভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার গেজেট প্রকাশ করে বলেছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এতে দেখা যাচ্ছে, যার যার পছন্দের লোক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ জন্য আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজনের কথা বলেছি।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘দুটি কারণে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। প্রথমত, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধির দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের লোকজন। তারা এখন ঠিকমতো কাজ করছেন না। এতে নাগরিক সেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এ দায় সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার আদৌ কাজ করছে কি না, প্রশাসন প্রভাবমুক্ত হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো।’
সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিপক্ষে মিত্ররা
সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ দল, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লেবার পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। এর বাইরে জাতীয় পার্টি, সমমনা ইসলামপন্থি চার দল, সিপিবি ও বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটও আগে সংসদ নির্বাচন চায়।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা (গণতন্ত্র মঞ্চ) জাতীয় নির্বাচন আগে চাই। গত ১৫ বছর মানুষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য তো আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। তারা জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য আন্দোলন করেছে। দলীয় কোনো স্বার্থে বা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয় সামনে এনে সরকারকে লম্বা সময় ক্ষমতায় রাখতে চাইছে কেউ কেউ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে ফ্যাসিবাদ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। সুরাহা হওয়ার অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক ও বিভাজন তৈরি করার জন্য সামনে আনা হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় রাখা বা তাদের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন মেনে নেব না। যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। অতীতে দেশে নির্বাচিত সরকারই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করেছে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স খববের কাগজকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা তুলে গণতন্ত্রের যাত্রার নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাইছে। এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চাই। এরপর নির্বাচিত সরকার এসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে। আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকার আগে হলে নানা অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। তাই যারা বলছে সেই সব দলকে নতুন করে বিবেচনা করা উচিত হবে।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে না। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীক নাকি স্বতন্ত্রভাবে হবে- এটা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনের পক্ষে স্থানীয় পর্যায়ে মারামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’
অন্যদিকে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজনের পরামর্শ ইসলামপন্থি চারটি রাজনৈতিক দল- খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম পার্টি। সমমনা ইসলামপন্থি দলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব দল যদি ঐকমত্য হয় তাহলে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে। ঐকমত্য না হলে মাঠপর্যায়ে মারামারি-হানাহানি বৃদ্ধি পাবে।