
দুবাইয়ে ১২৯ বাংলাদেশির ৮৪৭টি সম্পদের (প্রপার্টি) খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব সম্পদের মধ্যে আলিশান ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, দোকান, বাণিজ্যিক স্থাপনা, অফিস আছে। এসব সম্পদের মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে হিসাব কষা হয়েছে। দেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে এসব সম্পদ কেনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একযোগে তদন্ত করছে। গত আট মাস তদন্তের পর এসব ব্যক্তির নাম ও তাদের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত চলমান রয়েছে। এ তালিকায় আরও ব্যক্তি ও তাদের সম্পদের হিসাব যোগ হবে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এনবিআর থেকে এসব ব্যক্তি ও তাদের সম্পদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। এনবিআর থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতি এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে অর্জিত অর্থ দেশে আনতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এফসিএমএ খবরের কাগজকে বলেন, অর্থ পাচার করে বিদেশে অর্থ জমানো, সম্পদ করার দিন শেষ হতে চলেছে। অতীতে এসব অপরাধ করে পার পাওয়া গেলেও বর্তমান সরকারের সময় তা পার পাওয়া যাবে না। সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তদন্ত চলছে। অর্থ পাচারকারীদের ধরতে এবং পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সরকারের সব প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করে কাজ করছে।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থ পাচারকারীর মধ্যে সাবেক সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সবচেয়ে বেশি ১৩৬টি সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট, ভিলা, বাণিজ্যিক স্থাপনা ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এসবের মূল্য ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে হিসাব কষা হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, আশিকুর রহমান লস্করের ৩০টি ফ্ল্যাট, আজিজ আল কায়সারের ১৪টি ফ্ল্যাট, হাসান মাহমুদ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের চারটি করে ফ্ল্যাট, আবু ইউসূফ এমডি আবদুল্লাহর ছয়টি ফ্ল্যাট, আহমাদ ইমরান চৌধুরীর ১০টি ফ্ল্যাট, মিজানুর রহমানের চারটি ফ্ল্যাট, আনিসুজ্জামান চৌধুরীর পাঁচটি ফ্ল্যাট, আঞ্জুমান আরা সাইদির পাঁচটি ফ্ল্যাট, আনোয়ারা বেগমের চারটি ফ্ল্যাট, ফারহানা মোনের চারটি ফ্ল্যাট, ফারজানা চৌধুরীর সাতটি, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া ও হাজি মোস্তফা ভূঁইয়ার যৌথ নামে ১০টি, এইচ বি এম ইকবালের এক নামে আটটি ফ্ল্যাট এবং এ কে এম জিল্লুর রহমানের সঙ্গে যৌথ নামে আরও আটটি ফ্ল্যাট আছে, আবদুল মজিদ আল মো. মকবুলের নামে ১০টি ফ্ল্যাট, মির্জা সায়মা মাহমুদের নামে ১০টি ফ্ল্যাট, কাজী মো. ওসমানের ১২টি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খালিদ হেকমত আল ওবাইদির নামে ১৩টি ভিলা, ইফতেখার রানার নামে দুটি ভিলা ও দুটি বাণিজ্যিক স্থাপনা, এম সাজ্জাদ আলমের নামে আটটি ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট, হাসান রেজা মাইদুল ইসলামের নামে হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট, হুমায়রা সেলিম ও সেলিমুল হক এশার নামে যৌথভাবে বুর্জ খলিফায় চারটি ফ্ল্যাট, মনোজ কান্তি পালের নামেও বুর্জ খলিফায় ১৪টি, আরমান হোসেনের নামে আটটি দোকান ও দু্টি অফিস, মো. সালমানের ১১টি ভিলা, মো. সাইফুল আলমের নামে হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট, মো. ইদরিস শাকুরের নামে ১৪টি অ্যাপার্টমেন্ট, ছয়টি ভিলা ও একটি হোটেল, মোস্তফিজুর রহমানের নামে ২০টি ফ্ল্যাট, ১৩টি ভিলা ও ১১টি বাড়ি, নজরুল ইসলাম আনু মিয়ার আটটি ভিলা, রুবাইত লস্করের ৩৮ প্রপার্টির খোঁজ পাওয়া গেছে; এর মধ্যে ফ্ল্যাট, ভিলা ও বাড়ির খোঁজও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, এসব ব্যক্তি বেশির ভাগ অর্থ হুন্ডিতে পাচার করেছেন। অনেকে আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে মিথ্যা তথ্য দিয়েও পাচার করেছেন। নিজের দুর্নীতি আড়াল করতে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (হিসাব) অর্থ জমা না রেখে অন্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শেষ সময়ে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (হিসাব) থেকে বেশির ভাগ অর্থ তুলে নিয়েছেন, যা হুন্ডিতে পাচার করে দিয়েছেন। বিগত সরকারের সময়ে গত ১৫-১৬ বছর বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অর্থের প্রায় সবটা পাচার করে দিয়েছেন।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব ব্যক্তির দেশেও প্রচুর সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের বেশির ভাগই বেনামে করা। অভিযোগ আছে, এসব ব্যক্তি দুবাই ছাড়াও অন্যান্য দেশেও সম্পদ করেছেন। তবে দুবাইয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, এ পর্যন্ত বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এক হাজারের বেশি ব্যক্তির অর্থ পাচারের তদন্ত করা হচ্ছে। এসব ব্যক্তি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। এদের আয়ের বৈধ উৎস না থাকায় অর্থ পাচার করেছেন। এদের অনেকে পাচার করা অর্থের চেয়ে অনেক কম পরিমাণ দেশে রেখেছিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন বাড়তে থাকে, তখন অনেকে নিজের অ্যাকাউন্টে যা ছিল তার প্রায় সবটা তুলে পাচার করে দিয়েছেন। এসব ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (হিসাব) ফ্রিজ (হিসাব জব্দ) করলেও ফাঁকি দেওয়া করের সমান টাকা পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থার (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, বিগত সরকারের এসব ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তাদের অবৈধ ও বৈধ সব অর্থ পাচার করে দিয়েছেন। পাচারের অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যে দেশে পাচার হয়েছে, সে দেশে এসব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে ওই দেশে ল’ফার্ম নিয়োগ দিয়ে আইনি পথে পাচারের অর্থ আদায় করতে হবে। বিদেশের সম্পদের দলিল জোগাড় করে বিক্রি করে অর্থ উদ্ধার করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। তবে সরকার জোর দিয়ে কাজ করলে পাচারের অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।
অন্যদিকে ৪৫৯ বাংলাদেশির অর্থ পাচার করে গোল্ডেন ভিসায় দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে ৭০ জনকে চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।