
আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, গ্রহণ করা হবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। সরকারের চেষ্টা থাকবে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় প্রণীত প্রতিবেদন থেকে এসব জানা গেছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ট্যারিফ কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছ থেকে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের (কেন্দ্রীয়) গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ এবং রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়ে জোর দিয়েছেন। উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা এবং পণ্য সংগ্রহের বাড়তি ব্যয় কমাতে চাঁদা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দেওয়া পরামর্শের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত বা কমানো, অযৌক্তিক ব্যয়, অর্থ সরবরাহ, ভর্তুকি কমানো ও কঠোর বাজার তদারকির কথা বলা হয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রথমবারের মতো অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছি।’
রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন। এবারে সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২ জুন সোমবার বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
এনবিআর চেয়াম্যান ড. আবদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের সামনে রাজস্ব আদায়ের বড় লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মূল্যস্ফীতি কমানোর স্বার্থে বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে অনেক ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কে ছাড় রাখা হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, ‘পণ্যের মূল্যসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং তা মেনে পণ্য বা সেবা বিক্রি হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি বাড়াতে হবে। সরকার দীর্ঘমেয়াদে প্রতিটি জেলা ও থানা পর্যায়ের কাঁচাবাজারে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থায়ীভাবে কাঁচাবাজার ও অন্যান্য দৈনন্দিন জিনিসপত্র ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে। বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহব্যবস্থা তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য থানা ও জেলা পর্যায়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। টাস্কফোর্সের কাজের অগ্রগতি সবার জন্য প্রকাশ করতে হবে। পণ্য পরিবহন থেকে সব ধরনের চাঁদাবাজি কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন বেসরকারি, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে পারে।’
মূল্যস্ফীতি কমাতে উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় সহযোগিতা পাচ্ছেন না। কৃষিকাজ লাভজনক না হওয়ায় অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এতে উৎপাদন কমে যেতে পারে। কৃষিকাজে মূলধন সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, উন্নতমানের বীজ, সার এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়তা বাড়াতে হবে। পণ্য সংরক্ষণে গুদামের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দামের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও গড় মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। যা সম্ভব হয়নি। সরকার পণ্যমূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় এবং সুদ হার বাড়ায়। তবে, এসব খুব কাজে আসছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে প্রয়োজন যথাযথভাবে বাজার তদারকি ও সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া। আগামী বাজেটে এই জায়গায় জোর বাড়াতে হবে। সরকার অনেক কথা বলছে এসব কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়ছে না। ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না।
ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ড হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য থাকতে হবে। না থাকলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। দেশে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে মজুরির হার বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। সরকারকে সাধারণ মানুষের আয় বাড়াতে নজর দিতে হবে। না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যত পদক্ষেপ নেওয়া হোক না কেন তা খুব একটা কাজে আসবে না।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজদের বিতাড়িত করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশনকে কার্যকর করতে হবে। বাজার কিছু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ থেকে মুক্ত করতে হবে। এসব আগামী বাজেটে আনতে হবে। না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
সিফাত/