
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই মিথ্যা তথ্যে ভোটার হয়ে ইসির হাতে ধরা খেয়েছে কিশোর মো. আরাফাত। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার নামাপুটিয়া গ্রামে। এ ঘটনায় আরাফাত এবং প্রতিবেশী ভাই জহিরুল ইসলাম জুয়েলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ইসির সিস্টেম অ্যানালিস্ট (তথ্য ব্যবস্থাপনা) প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে তিনি জানান, আরাফাতের প্রকৃত জন্মসাল ২০১০, বয়স ১৫ বছর। তার বয়স ২২ বছর করতে ভুয়া জন্মসনদ বানিয়ে আপলোড করা হয় এবং ছবি, চোখের আইরিশ ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে অন্য লোকের। এ বিষয়ে ইসির এনআইডি শাখার মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর খবরের কাগজকে জানান, ঘটনায় আটক ২ জনসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সপ্তম তলায় গিয়ে কাঁদতে দেখা যায় আরাফাতকে। জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, তার এনআইডিতে অন্য লোকের ছবি আপলোড করা হয়েছে, যাকে তিনি চিনেন না। প্রতিবেশী ভাই জহিরুল তাকে ইসিতে ছবি পরিবর্তন করার জন্য নিয়ে এসেছেন। আরাফাতকে প্রশ্ন করা হয়, সে কীভাবে ভোটার হলো? জবাবে সে বলেছে, ‘আমার ফুপাতো বাইয়ে কইছে যে বিদ্যাশ (কাতার) নিব। আমি হেরে কইছি আইডি কার্ড করন লাগব? হেয় লগে লগে কইছে কইরা দিব।’
আকুতি জানিয়ে আরাফাত বলে, ‘আপা, আমি তারে জোরাজুরি করি নাই। আমি এইট পর্যন্ত পড়ছি। আমার বাবাও বিদ্যাশ থাকে, সৌদি আরবে। দালালের মাধ্যমে গিয়ে সে এখনো কাজ পায়নি। আমরা ৩ ভাই এক বোন। অভাবের সংসারে মা আমারেও বিদ্যাশ পাঠাইতে চায়। তাই অই ভাইয়ের কথায় ভোটার হওয়ার আবেদন করি। কাতার পাঠাবে বইলা ভাই আমারে ভোটার হইতে বলে। কারণ এনআইডি ছাড়া পাসপোর্ট করতে পারুম না, বিদ্যাশে যাইতে পারুম না।’
আরাফাত জানায়, এক মাস আগে ভোটার তালিকা হালনাগাদের আগেই পাকুন্দিয়া উপজেলার নির্বাচন অফিস থেকে তার ভাই ভোটার হওয়ার আবেদন করিয়ে দেন। তার আগে জহিরুল আরাফাতের ২২ বছরের ভুয়া জন্মসনদ, ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট ও কাগজপত্র বানিয়ে দেন। আরাফাতের এনআইডির আবেদন করাতে জহিরুল স্থানীয় নির্বাচন অফিসের ঝাড়ুদার রকির সহায়তা নেন। এসব কাজের জন্য এ পর্যন্ত খরচ হিসেবে নেন ৯ হাজার টাকা। তবে পরে জহিরুল রকিকে ভাগের টাকা না দেওয়ায় সে আরাফাতের ছবি ও বায়োমেট্রিক না নিয়ে প্রক্সি হিসেবে অন্য লোকের এসব তথ্য ব্যবহার করে। পরে আরাফাত এনআইডিতে নিজের ছবির বদলে অন্য লোকের ছবি দেখতে পায়।
এ ঘটনার ব্যাপারে জহিরুলকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, আরাফাতের মায়ের কথায় তিনি এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন। দালাল নন এমন দাবি করে তিনি বলেন, পেশায় তিনি স্থানীয় ভূমি অফিসের আমিন। কৃষিকাজও করেন। আরাফাত সম্পর্কে তার বউয়ের মামাতো ভাই। বয়স বাড়িয়ে জন্মসনদ করতে টাকা খরচ হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন অফিসের ঝাড়ুদার রকির কাজটি করে দেওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে আরাফাতের ছবির বদলে এনআইডিতে অন্য লোকের ছবি বায়োমেট্রিকে আপলোড করা হয়েছে- সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি জহিরুল। বিদেশে লোক পাঠাতে স্থানীয় দালালদের সঙ্গে তার কোনো কাজের সম্পর্ক রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন জহিরুল।
আইনে মিথ্যা তথ্যে ভোটার হওয়ার শাস্তি
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে কোনো নাগরিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করলে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব পালনরত কোনো ব্যক্তি, কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া, দায়িত্বে অবহেলা করলে সেটা এই আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
আরাফাতের ভোটার হওয়ার বিষয়ে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ খবরের কাগজকে জানান, আরাফাত নামে কোনো কিশোর বা ব্যক্তির ভোটার হওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।
আপনার অফিসের ঝাড়ুদার (রকি) এর মাধ্যমে কোনো কর্মকর্তা এ কাজে জড়িত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখনো আমার নলেজে নেই। আমি জানিও না। ঢাকা অফিসে যেহেতু তথ্য চলে গেছে, সেখান থেকে নির্দেশ পেলে সে অনুযায়ী তদন্ত করা হবে। আমার অফিসের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভোটার ও এনআইডি কার্যক্রমে যেকোনো ধরনের প্রতারণা ও দায়িত্বে অবহেলাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় বলে জানান নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখার মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর। গতকাল সোমবার তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আরাফাত নামের ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটি বয়স বাড়িয়ে মিথ্যা তথ্যে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছে। নির্বাচন অফিসে গতকাল সে তার ছবি পরিবর্তনের জন্য এলে এনআইডির তথ্য ও ছবি, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে থাকা বয়স আর সরাসরি তাকে দেখে আমাদের কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে ছেলেটি জানায়, কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরুর আগেই আরাফাত ভোটার হওয়ার আবেদন করতে যায়। কিন্তু বয়স কম থাকায় কর্মকর্তা তাকে ভোটার বানানো যাবে না বলে জানান। পরে সে এক প্রতিবেশী ভাই জহিরুলের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে আবেদন করে। এ কাজ করিয়ে দিতে তার সেই ভাই দালালের মাধ্যমে স্থানীয় নির্বাচন অফিসের ঝাড়ুদার রকিকে টাকা দেন। কিন্তু রকি সেই টাকা না পেয়ে অন্য লোকের ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে এনআইডির কাজ শেষ করেন।’
এনআইডি শাখার মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘ইসিতে ছবি সংশোধন করতে আসা আরাফাতের ভোটার হওয়ার ঘটনা আমরা জানতে পারি। প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনায় মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অফিসে আসা দুজনের সাক্ষাৎকার ও লিখিত বক্তব্যও নেওয়া হয়েছে। আরাফাতের আবেদন এ পর্যায়ে লক করে রাখা হবে। অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের কারসাজিতে জড়িতদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আরাফাতসহ জালিয়াতিতে জড়িত তার প্রতিবেশী ভাই জহিরুল, স্থানীয় অফিসের ঝাড়ুদার এবং কর্মকর্তাদের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’