
আগামী অর্থবছরের বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সহজ পথ হিসেবে অনেক পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বাড়ানো হচ্ছে। অনেক খাতে ভ্যাট বাড়িয়ে দ্বিগুণও করা হয়েছে। ভ্যাট বাড়ানোর ফলে বাজেট ঘোষণার পরই সংশ্লিষ্ট খাতের পণ্য ও সেবা পেতে ভোক্তাকে আগের থেকে বেশি খরচ করতে হবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের পণ্যে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে বলে জানা গেছে। ভ্যাটের মারপ্যাঁচে আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পরই সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের দাম বাড়বে। প্লাস্টিকের জুতা, স্যান্ডেল থেকে ঘরগৃহস্থালি পণ্য এবং আসবাবপত্রের দাম বাড়বে।
সব ধরনের খেলনায় ভ্যাট বাড়িয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৫ শতাংশ করা হবে। এতে খেলনার দাম বাড়বে। রডের উৎপাদন ও আমদানিতে ভ্যাট বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে নির্মাণ খাতে। আবাসন খাতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে দাম বাড়বে সংশ্লিষ্ট খাতে। মোবাইল ফোন সেট, এসি, ফ্রিজের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে। এসব পণ্য বেশি দামে কিনতে হবে। সব ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ খাবারে বাড়তি ভ্যাট বহাল থাকবে। এতে দেশি বিস্কুট, জুস, চকলেটের দাম বাড়বে।
আগামী অর্থবছরে অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন বাধ্যতামূলক থাকছে। আগামী বছর থেকে পাড়া-মহল্লা ও উপজেলা পর্যায়ের দোকান থেকে ভ্যাট আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব দোকান থেকে এতদিন ভ্যাট আদায় হতো না বললেই চলে। এসব দোকানে কিছুটা কম দামে পণ্য কেনার সুযোগ থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা থাকছে না। এসব দোকানকে ভ্যাট পরিশোধে বাধ্য করা হবে। এতে বিক্রেতেরা পণ্যের দামের সঙ্গে ভ্যাট যোগ করে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করবেন। ফলে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সহজ পথ হিসেবে সরকার ভ্যাটের হার বাড়ালে অনেক পণ্য ও সেবা পেতে বাড়তি খরচ করতে হবে। এতে ধনীদের জন্য সমস্যা না হলেও সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর হবে।
এনবিআরের বাজেটবিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আইএমএফের সুপারিশে রাজস্ব খাতের সংস্কার করা হবে এমন শর্ত মেনেই দাতা সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। সংস্কারের মধ্যে ভ্যাটের হার বাড়ানোর শর্ত ছিল অন্যতম। আইএমএফ থেকে নতুন করে ভ্যাট অব্যাহতি না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে বহাল আছে এমন বেশির ভাগ খাতের ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হবে এবং কমানোর সুপারিশও করা হয়েছে। বেশির ভাগ খাতে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছিল। আইএমএফ থেকে চার বছরে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪ সালে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, ২০২৫ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৬ সালে ২ লাখ ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করার জন্য বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত সরকারের করা অঙ্গীকার মানতে আগামী বাজেটে ভ্যাট হার বাড়ানোর পথে হাঁটতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশ থেকে ১০ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্লাস্টিকশিল্পের সঙ্গে জড়িত পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ লাখ মানুষের। বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার। অভ্যন্তরীণ চাহিদা শতভাগ পূরণ করতে পারছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্লাস্টিক খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আরএফএল, গাজী, বেঙ্গল, ওয়ালটন, আকিজ, তানিন ইত্যাদি। অন্যদিকে ওয়ালমার্ট, টেসকো, জারার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বর্তমানে বাংলাদেশি প্লাস্টিক পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতা।
বিপিজিএমইএ সভাপতি সামিম আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, সাধারণ মানুষ প্লাস্টিক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। প্লাস্টিক খাতে আছে কয়েক শ ধরনের পণ্য। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সরকার প্লাস্টিক পণ্যের ওপরও ভ্যাট বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিলে সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের দাম বাড়বে। দেশি প্লাস্টিক খাতে গতিশীলতা কমবে। প্লাস্টিক পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়বে দেশের প্লাস্টিকশিল্প। প্রভাব পড়বে রপ্তানিতেও।
অন্যদিকে সব ধরনের খেলনার উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আগামী বাজেটে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশি খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান শোভা খেলনা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, খেলনাশিল্পে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। তবে ভ্যাট আরোপ করা হলে এ সম্ভাবনা নষ্ট হবে। এখন যে দামে খেলনা বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে দাম বাড়বে।
ব্যাটারি তৈরির ওপরও বিদ্যমান ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হতে পারে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রিজ/এসিশিল্পের করপোরেট কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এসব কমানোর দাবি থাকলেও আগামী বাজেটে তা বহাল রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে ফ্রিজ ও এসির উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আগামী বাজেটে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রোমার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আফসার খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাট দ্বিগুণ হলে ফ্রিজের দাম ২ থেকে ৩ হাজার টাকা এবং এসির দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেড়ে যাবে। আইএমএফের চাপে এটা করা হলে এ দুই শিল্পের বাজার কমবে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ওপর বাড়তি ভ্যাট কমানোর দাবি করা হলেও তা কমানো হচ্ছে না। বরং এ খাতে সব ধরনের ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে এ খাতের অন্তর্ভুক্ত সব পণ্যের দাম বাড়বে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে (গত জুন মাসে) মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করে। এখন সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ মিলিয়ে মোট করভার ৩৯ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরে সিমের দাম ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোনসেট উৎপাদনে ভ্যাট ক্ষেত্রবিশেষে ৫ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বহাল আছে। আগামী অর্থবছরে এ হার বাড়িয়ে ৭ ও ১০ শতাংশ করা হতে পারে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি ৬২ লাখ।
মোবাইল ফোনের মতো সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্যের ভ্যাট বাড়ানো হলে জীবনযাত্রায় কী প্রভাব পড়বে- জানতে চাওয়া হলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, মোবাইল ফোন এখন আর বিলাসী পণ্য না। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দৈনিক জীবনযাত্রার জন্য অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
আগামী অর্থবছরে মোবাইল ফোনসেট উৎপাদনে নতুন করে ভ্যাট বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর খরচের চাপ বাড়বে।
আগামী অর্থবছরে সিগারেট, মোবাইল ফোন, তেল ও গ্যাস, গাড়ি, সিমেন্ট, ব্যাংকসহ বড় কয়েকটি খাতে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর থাকছে। ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ বা ৭ শতাংশ ধার্য থাকলেও আগামী বাজেটে বেশির ভাগ খাতে এসব হার বাড়ানো হচ্ছে।