
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বড় পরিবর্তন আসছে। গরিবদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই কর্মসূচি আরও দরিদ্রবান্ধব করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার আগের তুলনায় ছোট হলেও ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়ছে। তরুণদের জন্য থাকছে বিশেষ বরাদ্দ।
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চূড়ান্ত করে ফেলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্ভাব্য আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে সোমবার ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট দেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
জাতীয় সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় এ বছর সেটি হবে না।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এবার তুলনামূলক ছোট বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার বাজেট হবে সমতাভিত্তিক ও জনকল্যাণমুখী। বাস্তবতার সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ‘বাস্তবায়নযোগ্য’ বাজেট দেবেন তিনি।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন বাজেটে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করবেন অর্থ উপদেষ্টা। নতুন কোনো করারোপ নয়, বরং করকাঠামোকে যৌক্তিকীকরণ করে ‘বাড়তি’ রাজস্ব আহরণের কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, করকাঠামো যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করে কিছুটা ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করবেন সালেহউদ্দিন। সরকারি চাকরিজীবীদের খুশি করতে মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা থাকছে বাজেটে।
এই বাজেটে কৃচ্ছ্রসাধন অব্যাহত থাকলেও কিছু খাতে নতুন করে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকছে, যাতে শহিদ পরিবারের সদস্যরা ও আহতরা সম্মানী ভাতা পান। এ ছাড়া দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কে নিরাপত্তা বাড়াতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, যেহেতু আয় সীমিত। তাই ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করে নতুন বাজেট সাজানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গ সামাজিক কর্মসূচি: বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন। নতুন বাজেটে এই কর্মসূচি কমিয়ে ১০০টি করা হচ্ছে। তবে হতদরিদ্রদের জন্য ৩৮টি আলাদা কর্মসূচি চালু করা হচ্ছে।
কর্মসূচির সংখ্যা কমিয়ে আনার ফলে নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া আছে, তা মোট বাজেটের ১৬ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, নতুন বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে মোট বাজেটের ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা এখন আছে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেসব কর্মসূচি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এই কর্মসূচিকে দেখানো হতো এতদিন। এমন কিছু কর্মসূচি আছে, যেগুলো সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় পড়ে না- সেগুলোকেও আওতায় এনেছে বিগত সরকার। যেমন, পেনশন সুবিধাকেও এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়নসহযোগীরা এ ধরনের কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও বাস্তবমুখী করতে চায় বর্তমান সরকার। এ জন্য হতদরিদ্রদের জন্য পৃথক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ৩৮টি কর্মসূচির আওতায় ৫২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, নতুন বাজেটে বয়স্ক, বিধবাসহ অন্য উপকারভোগীর মাসিক ভাতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উপকারভোগীর সংখ্যা। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতাও বাড়ানো হচ্ছে। এখন সারা দেশে ৫০ লাখ দুস্থ পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল খাওয়ানো হচ্ছে। এই সংখ্যা আরও ৫ লাখ বাড়ছে। তাদের জন্য ১০ লাখ টন চাল বিতরণের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে, যা এখন আছে ৭ লাখ ৬০ হাজার টন। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় প্রতি পরিবারকে ছয় মাসে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হবে। প্রতি কেজির দাম পড়বে ১৫ টাকা। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে গরিবদের জন্য আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি চালু রয়েছে। কাজের বিনিময়ে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয় উপকারভোগীকে। নতুন বাজেটে মজুরি বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করা হচ্ছে। এখন ৫ লাখ সুবিধাভোগী এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। আগামী বাজেটে সংখ্যা বাড়িয়ে আরও ৫ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়,বর্তমান সরকার তারুণ্যের শক্তিকে দেশের উন্নয়নকাজে সম্পৃক্ত করতে চায়। সে জন্য তাদের আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়ছে: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট তুলনামূলক ছোট হলেও বাড়ছে ভতুর্কির পরিমাণ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে এটি বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিতে মোট বরাদ্দ থাকছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে তাতে ভর্তুকি ধরা হয় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভর্তুকি অনেকে বেড়েছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে চাপ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ভর্তুকি খাতে ব্যয় মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ। ভর্তুকি একটি অন-উৎপাদনশীল খাত। এ জন্য এই খাতে ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য উন্নয়নসহযোগীসহ দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা তাগিদ দিয়ে আসছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হয়। তবে কোন খাতে ভর্তুকি দেওয়া হবে, আর কোন খাতে দেওয়া হবে না- এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য আট বছরে ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ গুণ বা ৯০০ শতাংশ।
বর্তমানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষি, রপ্তানি, খাদ্য ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে ভর্তুকি দেয় সরকার। তবে ভর্তুকি ব্যয়ের বেশির ভাগ যায় বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে। বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দুটি খাতে ভর্তুকি বেশি দিতে হচ্ছে সরকারকে। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতে মূল বাজেটে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পরে সংশোধিত বাজেটে এই বরাদ্দ বেড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। নতুন বাজেটে প্রাথমিকভাবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সংশোধিত বাজেটে এই বরাদ্দ দ্বিগুণ হবে। পাঁচ বছর আগে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানি তেলনির্ভর। তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। যে কারণে ভর্তুকি বেশি লাগে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৯ হাজার কোটি টাকা, যা এখন আছে ৬ হাজার কোটি টাকা। খাদ্যে দেওয়া হচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা এখন আছে ৬ হাজার কোটি টাকা। কৃষিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে আছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে দেওয়া হচ্ছে যথাক্রমে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি ও ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই দুটি খাতে বরাদ্দ অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
সুদ পরিশোধে সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব: নতুন বাজেটে একক খাত হিসেবে ঋণের সুদ পরিশোধে সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এবার সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২২ শতাংশ। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে তাতে এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।