
বিগত ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৯ কোটি ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৮২০ জন মানুষের বসবাস। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কাছে বন্যা-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক খবর পাওয়ার মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর এবং বেসরকারি টেলিভিশন। এর বাইরে আছে ৮টি কমিউনিটি রেডিও। কিন্তু এ রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সময়েও রেডিও উপকূলীয় মানুষের কোনো কাজে আসছে না।
কমিউনিটি রেডিওগুলো উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের খবরসহ ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রচার করে থাকে। কিন্তু এদের সম্প্রচার সক্ষমতা কম এবং দেশে রেডিওর ব্যবহার তেমন না থাকায় কমিউনিটি রেডিও মানুষের তেমন কাজে আসছে না। ফলে উপকূলের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো রেডিওর বার্তা থেকে বঞ্চিত থাকছে। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি প্রচার মাধ্যমের ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে কয়েকটি জেলার অবস্থান উপকূলীয় অঞ্চলের কাছাকাছি এবং কয়েকটি জেলা উপকূলের অংশ।
কমিউনিটি রেডিওসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে কমিউনিটি রেডিওগুলোর এই কার্যক্রম স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে এবং দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সংবাদ শুনে মানুষ দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন বা ত্রাণ-সহায়তা পেতে পারেন। কিন্তু কমিউনিটি রেডিও প্রচারের নীতিমালা অনুযায়ী কমিউনিটি রেডিওগুলোর সম্প্রচার সক্ষমতা বেশি নয়। দুর্বল ট্রান্সমিশন ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে কমিউনিটি রেডিওগুলো দুর্যোগের খবর পুরো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন বা আয়ের উৎস না থাকায় স্টেশনগুলো চলমান রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের বরগুনা সদরের লোকবেতার, আমতলী উপজেলার কৃষি রেডিও, ভোলার চরফ্যাশনের রেডিও মেঘনা এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরায় রেডিও নলতা নামে কমিউনিটি রেডিও চালু আছে। লোকবেতারের সম্প্রচার এলাকা মাত্র ৫১ কিলোমিটার, কৃষি রেডিওর ৪৫, রেডিও মেঘনার সাড়ে ১৭ এবং নলতার ৪১ কিলোমিটার। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকার দূরত্ব এর চেয়ে অনেক বেশি। দেশে দিনে দিনে রেডিওর ব্যবহার কমে যাওয়ায় কমিউনিটি রেডিও শ্রোতা পাচ্ছে না। বিভিন্ন দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় উপকূলীয় রেডিও কোনো রকমে টিকে আছে। তারা বিভিন্ন সমিতি এবং ক্লাব বানিয়ে শ্রোতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
পিরোজপুর জেলার সমুদ্রগামী মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি কমল সাহা জানান, গভীর সমুদ্রগামী ট্রলারে দুর্যোগকালে বিভিন্ন সংবাদ এবং আবহাওয়ার সংবাদ জানার জন্য মোবাইল ফোন এবং এফএম রেডিওর ব্যবহার হয়ে থাকে। কিছু কিছু ট্রলারে এখনো পুরোনো ব্র্যান্ডের কিছু রেডিও থাকলেও তার ব্যবহার তেমন একটা হয় না। কারণ ওই সব রেডিওতে বাংলাদেশ বেতার কিংবা বেসরকারি রেডিওর কোনো সম্প্রচার শোনা যায় না। বর্তমানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেশি। দুর্যোগের সময় নেটওয়ার্ক খারাপ থাকলে মোবাইলে এফএম রেডিও শোনা যায় না।
মঠবাড়িয়া এলাকার ইব্রাহিম শেখ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কমিউনিটি রেডিওর সংকেত (ফ্রিকোয়েন্সি) পাওয়া যায় না। দেশে রেডিওর ব্যবহার নেই। তাই বাংলাদেশ বেতার বলেন আর কমিউনিটি রেডিও, মানুষ কোনো রেডিও শোনেন না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন ও বাটন ফোন। বিদ্যুৎ না থাকলেও যেকোনো অবস্থায় তারা মোবাইল ফোন দিয়ে এফএম রেডিও শুনতে পারছেন। পাচ্ছেন সব খবর।’
তালতলী উপজেলার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি জানি না কমিউনিটি রেডিও চালু আছে কি না। দুর্বল নেটওয়ার্কের জন্য তাদের প্রচারিত বার্তা আমরা শুনতে পাই না। দুর্যোগের সময় তাহলে এটা আমাদের কী উপকার করবে? উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে রেডিও ব্যবহারের ওপরে সচেতন করতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।’
স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম মেহেদি বলেন, দুর্যোগের সময় উপকূলের বাসিন্দাদের জীবনের অংশ হওয়ার কথা ছিল কমিউনিটি রেডিওর। কিন্তু এই রেডিওর অস্তিত্বই এখন সংকটে। দুর্যোগের সময় ফেসবুক লাইভেও তারা প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন।
লোকবেতারের অনুষ্ঠান উপস্থাপক মো. সালমান বলেন, ‘আমরা সরাসরি সম্প্রচার করি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই কতজন আমাদের রেডিও শুনছেন। তবে আমরা ফেসবুক লাইভে আমাদের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের কিছু সাড়া পাই।’
রেডিও স্বপ্নের পরিচালক শহীদুল ইসলাম স্বপ্ন বলেন, টেকসই সম্প্রচারের জন্য শক্তিশালী ট্রান্সমিটার, ফ্রিকোয়েন্সি সম্প্রসারণ এবং ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজন। একসময় আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় নির্মিত রেডিওগুলো এখন টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। দাতা সংস্থার প্রকল্পগুলোর সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। ফলে তারা আর সহায়তা করে না। এখন তাই অনলাইনভিত্তিক সম্প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কার্যকর মোবাইল অ্যাপ, ইউটিউব চ্যানেল এবং নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হলে মানুষ তথ্য পাবে। রেডিও টিকে থাকবে।
রেডিও মেঘনার সহকারী স্টেশন ব্যবস্থাপক উম্মে নিশি বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা আমাদের সম্প্রচার চলে। রেডিও মেঘনার বর্তমানে ফেসবুক পেজে প্রায় ১০ হাজার ফলোয়ার রয়েছেন। অফ লাইনে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার শ্রোতা রেডিও মেঘনা শোনেন। ২৫০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার থেকে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে রেডিও মেঘনা শোনা যায়। তবে একেবারে সাগরতীর পর্যন্ত আমরা সম্প্রচার করতে পারি না। আমাদের নিয়মিত অনুষ্ঠান ছাড়াও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় নিয়মিত বিশেষ বুলেটিন প্রচার করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, রেডিওটি সচল রাখতে ১০ জন নারী স্টাফ কাজ করছেন। এদের জন্য মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। রেডিও মেঘনার সঙ্গে যুক্ত আছে কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা। তারা ২৫ শতাংশ খরচ বহন করছে। অবশিষ্ট ব্যয়ভার মেঘনার উদ্যোক্তা সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন বহন করে।
কুয়াকাটা মৎস্য আড়ত মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. রহিম খান বলেন, ‘পটুয়াখালীতে কমিউনিটি রেডিও শুনতে পাই না। শুধু কমিউনিটি রেডিও নয়, কোনো কোনো সময় বাংলাদেশ বেতারও শুনতে পাই না। এখন ছোট-বড় সবার হাতে স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে এফএম রেডিও অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য জানতে পারছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উপকূলে কোনো কিছুরই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। উপকূলবাসী সঠিক তথ্য সময়মতো পান না।’
সাতক্ষীরা রেডিও নলতার স্টেশন ইনচার্জ মামুন হোসেন জানান, ২০১১ সালের ১৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া রেডিও নলতা বিভিন্ন সচেতন এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় আবহাওয়া বুলেটিন প্রচার করে। বর্তমানে রেডিও নলতার ৩০০টি শ্রোতা-ক্লাব রয়েছে। কিন্তু সম্প্রচার সক্ষমতা কম থাকায় সাতক্ষীরা জেলার একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকার মানুষ রেডিও নলতা শুনতে পান না।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন ডিভাইসের ওপর নির্ভর করতে হয়। দুর্যোগ এলেই এই এলাকায় বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটে। সে সময় স্থানীয়দের পুরোনো দিনের রেডিওর কথা মনে পড়ে যায়। যে উদ্দেশ্যে রেডিও কমিউনিটির প্রচলন ঘটেছিল, তার সুফল আমরা ঠিকমতো পাই না।’
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাতক্ষীরা প্রতিনিধি নাজমুল শাহাদাৎ জাকির, বরগুনা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন অপু, পটুয়াখালী প্রতিনিধি হাসিবুর রহমান এবং পিরোজপুরের হাসিবুল ইসলাম সহায়তা করেছেন)