
রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের তিন মাস পার হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় তাদের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিরোধ, নানা বিতর্ক, মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে সংশ্লিস্টতা, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ, দলের নিবন্ধন ও সাংগঠনিক ভিত্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মন্তব্য আসছে বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকেও। অনেকের মতে, গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিলেও দেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে নতুন বন্দোবস্ত অনেক কঠিন কাজ।
তবে এনসিপির নেতারা মনে করছেন, জনগণের সমর্থন এখনো তাদের পক্ষে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় দেশের মানুষের মধ্যে নতুন সংস্কৃতির প্রত্যাশা রয়েছে। সেদিকে খেয়াল রেখেই তারা জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে সরব হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চান। আসন্ন ঈদে জনসংযোগের পরিকল্পনায় বিতরণ করা হবে লিফলেট। দলের নিবন্ধন, গঠনতন্ত্র, জেলা ও উপজেলা কমিটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আগামীকাল সোমবারের সাধারণ সভায়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ চিন্তক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হঠাৎ করে হওয়ার নয়। গত ৫৪ বছরে রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। বছর তিনেক গেলে এনসিপি আসলেই কী করতে পারবে তা বলা যাবে। তবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দরকার। তারা প্রতিশ্রুতি যদি কার্যকর করার জন্য দিয়ে থাকে, তাহলে তা ইতিবাচক। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় খবর দেখি, তাদের দলেও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত লোক আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের রাজনীতির দিকে তাকাতে হবে। নেহরুর বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আসেনি।’
এনসিপির কার্যক্রম মূল্যায়নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটা পলিটিক্যাল পার্টি গড়ে তোলা অনেক কঠিন। বিভিন্ন ধরনের সাপোর্ট লাগে, সময় লাগে। সাংগঠনিক শক্তি লাগে, রিসোর্স লাগে। রাতারাতি কারও পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এনসিপি শুরু করেছে, তবে তারা প্রথম দিকে কিছু ভুল করেছে। এখন তারা সংশোধনের চেষ্টা করছে।’
‘তাদের (এনসিপি) একটা অ্যাডভান্টেজ আছে, বাংলাদেশের লোকেরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সিভিল সোসাইটি রাষ্ট্রের কাঠামো ধরে রাখতে চায়, যেখানে ৮০ শতাংশ লোক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছাত্রদের অভ্যুত্থানে সেই কাঠামোটা ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। আমার মনে হয়, তাদের জনগণের সমর্থন আছে, সেটা ভালো করে পর্যবেক্ষণও করছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তির দরকার বাংলাদেশে। সেই আশাটা তারা পূরণ করতে পারবে কি না, সেটা সময় বলবে। তারা যদি সততা, স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম এবং ত্যাগ দেখাতে পারে, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে’ যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনসিপির প্রতি জনগণের প্রত্যাশা আছে। যতদূর জানি, তারা নতুন কিছু করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টাও করছে। তবে তারা সফল হতে পারবে কি না, সময়ই বলে দেবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনসিপির রাজনৈতিক কার্যক্রমকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। তারা একটি সফল বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছে। বয়স কম হওয়ায় ভুল করবে স্বাভাবিক। তারা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, দীর্ঘ মেয়াদে ভালো করতে পারবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে।’
যেসব ইস্যুতে বিতর্ক
নেতৃত্বে কে থাকবেন এই ইস্যুতে মতভেদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ ঘটে এনসিপির। পরে নাহিদ-আখতারের নেতৃত্বে দলটির কার্যক্রম শুরু হয়। নির্বাচন, সংস্কার ইস্যু নিয়ে ভিন্নমত হয় বিএনপির সঙ্গে। দুই দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা যায়। পাল্টাপাল্টি উপদেষ্টাদের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।
জামায়াতের সঙ্গেও বিরোধ স্পষ্ট হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে এনসিপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হলে তারা বিষয়টির সমালোচনা করেন। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা হয়। পরে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ধানমন্ডিতে মব তৈরি করে ব্যবসায়ীকে হয়রানির চেষ্টাকালে আটক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়কসহ (পরে অব্যাহতি) দুজনকে ছাড়িয়ে আনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন দলের সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। পরে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
দলের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান এবং যুগ্ম সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল-আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পর্যালোচনা করে শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নাম ব্যবহার করে অনিয়ম করা হচ্ছে। অথচ আমাদের কোনো কমিটি নেই সেখানে। আমরা প্রশাসনকে বলেছি, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।’
নতুন বন্দোবস্ত নিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের প্রত্যাশা জনগণের আছে আমাদের প্রতি। কিন্তু সেটা এখনই পূরণ করা কঠিন। কারণ প্রতিষ্ঠিত শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, অনেক মেধাবী তরুণ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বিদেশ থেকে চলে এসেছেন দেশের জন্য কাজ করতে।’
গঠনতন্ত্র, জেলা-উপজেলা কমিটির খসড়া
এনসিপিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের গঠনতন্ত্র তৈরি এবং নিবন্ধন প্রস্তুতির জন্য গঠিত সেল তাদের খসড়া জমা দিয়েছে। আগামীকাল সোমবার সেটি সাধারণ সভায় চূড়ান্ত হতে পারে। একই সঙ্গে অর্ধেকের বেশি জেলা ও উপজেলার কমিটির খসড়া তালিকা করা হয়েছে, যা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দলের লোগো এবং সম্ভাব্য প্রতীক নিয়েও কমিটির সদস্যরা মতামত দিয়েছেন।
সাংগঠনিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ইতোমধ্যে যুব, শ্রমিক, প্রকৌশল উইং গঠন করা হয়েছে। অন্য পেশাজীবীদের নিয়েও পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। শহিদ পরিবার এবং আহতদের পুনর্বাসন নিয়ে কর্মপরিল্পনা করছেন তারা।
অন্যদিকে সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন নিয়েও পর্যালোচনা চলছে এনসিপির মধ্যে। দলটির মৌলিক সংস্কারের রূপরেখায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুদক সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার এবং জনপ্রশাসন সংস্কারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রূপরেখা প্রস্তুত ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মানুষ নতুন কিছু দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। নতুন সংবিধান চাচ্ছেন। সেদিক থেকে জনগণের সাপোর্ট আছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা আমার কাছে মনে হয় সবাই একটা সম্মানজনক অবস্থায় আসবে ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে। বিভিন্ন দলের ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী। মানুষের কাছে এনসিপির নেতারা যখন আরও যাবেন, তখন গণজোয়ার সৃষ্টি হবে।’
ঈদে ব্যাপক জনসংযোগের পরিকল্পনা, বিতরণ করা হবে লিফলেট
আসন্ন ঈদুল আজহায় দলটির নেতা-কর্মীরা ব্যাপক জনসংযোগের পরিকল্পনা করছেন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১৯টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে লিফলেট প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠন, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিলোপ, কৃষির আধুনিকায়ন, বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত, চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, নতুন সংবিধান এবং জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।