
পরপর দুই অর্থবছর অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। কমেছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। কোভিডের সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে এত কম প্রবৃদ্ধি আর কখনোই হয়নি। এই তো গেল অর্থনীতির চিরায়ত সংকট। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। গঠিত হয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাস্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
একদিকে রাজনীতি, অন্যদিকে অর্থনীতির সংকট- এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কাল সোমবার আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, যিনি একসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। সংসদ না থাকায় এবার বাজেট ঘোষণা করা হবে টেলিভিশন-বেতারে। বিকেল ৪টায় বাজেট বক্তব্য শুরু করবেন অর্থ উপদেষ্টা। অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এবারের বাজেট বক্তৃতার কপি হবে সংক্ষিপ্ত, ৫০ থেকে ৬০ পৃষ্ঠা। কাল সকালে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে নতুন অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এখনো অর্থনীতির বড় সমস্যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের অভাব। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। নতুন বাজেটে এই দুটি বিষয়ে বেশি নজর দিতে হবে অর্থ উপদেষ্টাকে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া মানে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়া। এর ফলে কর্মসংস্থান কমে যায়। বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুতগতিতে না বাড়লে, কারখানায় উৎপাদন না হলে মানুষের আয় বৃদ্ধির সুযোগও কমে যায়। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ দেখতে চান ব্যবসায়ীরা।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। জিনিসিপত্রের যা দাম- বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের, তাতে নির্ধারিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের স্বস্তি দিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেশবাসী।
সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে আয়করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি না, বিনিয়োগ বাড়াতে কী পদক্ষেপ থাকছে, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় কী থাকছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প- এসএমইর বিকাশ, রপ্তানিকে উৎসাহিত ও শেয়ারবাজার চাঙা করতে প্রণোদনা থাকছে কি না- এসব বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার পরিকল্পনা জানতে চান সংশ্লিষ্ট মহল। গরিবদের সুরক্ষায় গৃহীত ব্যবস্থার কথাও বলতে হবে ড. সালেহউদ্দিনকে। প্রবাসীদের জন্য কোনো প্রণোদনা থাকছে কি না, সে বিষয়েও উত্তর দিতে হবে অর্থ উপদেষ্টাকে।
আগামী বছরের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত তথা এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বের হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তুতি বিষয়ে বাজেট ঘোষণায় বিস্তারিত জানতে চান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যে সর্বোত্তম সেবা পেতে সরকারের উদ্যোগ দেখতে চায় সংশ্লিষ্ট মহল।
কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার এ সময়ে বাজেট প্রণয়ন করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কারের পথে থাকা এ সময়ে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের জন্য দুশ্চিন্তারও বটে। সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছর বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আগামী বাজেটে এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবেন অর্থ উপদেষ্টা, তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেশের জনগণ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি দিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কমবে না। তাই নতুন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে মূল লক্ষ্য না করে বরং সংকট মোকাবিলায় বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, নতুন বাজেট উচ্চাভিলাষী হবে না। এটি হবে বাস্তবায়নযোগ্য এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তাবিত বাজটের আকার আগের চেয়ে ছোট করে সাজানো হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির সুফল যেন সবাই পান, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে বাজট দেওয়া হবে। এই বাজেট হবে জনগণের জীবন-জীবিকা উন্নত করার বাজেট। সম্প্রতি সচিবালয়ে গণমাধ্যমেকে দেওয়া সাক্ষাৎকালে এসব কথা বলেন তিনি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছি। এ ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বা সম্পদের প্রাপ্যতার পরিমাণও কম। ফলে বাজেট কোনোভাবেই সম্প্রসারণমূলক করা উচিত হবে না। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে, তা কাজ করবে না।’ বাজেট ঘাটতি অবশ্যই কম রাখা সমীচীন হবে বলে মনে করেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশে লক্ষ্য স্থির করে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট অপেক্ষা ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের- এনইসি বৈঠকে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়। যা আগের বছর ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেছেন, বর্তমানে অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো। আগামী বাজেটে এসব বিষয়ে প্রতিফলন দেখা যাবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশ প্রাক্কলন করছে অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। জানা গেছে, সরকারের চলমান সংস্কার কর্মসূচিগুলো যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ধরনের কোনো উদ্যোগ বাজেটের মধ্যে থাকবে না। বরং এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ রাখা হবে। এ জন্য কাটছাঁটের মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কম। এতে ঘাটতির চাপও কমে আসবে বলে মনে করে অর্থ বিভাগ।