
চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে একেক সময় একেক রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে ভোট এলে জনপ্রতিনিধিরা কথার ফুলঝুরি ফোটান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না! বৃষ্টি হলেই জলজটের কারণে নগরবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এই সমস্যার প্রধান কারণ শহরের খালগুলোর সংস্কার না হওয়া। নগরে খাল রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৬টি খালের সংস্কারে এরই মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই মেগাপ্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। তবে এখানেও রয়েছে গলদ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের বাইরে থাকা বাকি ২১টি খাল সংস্কার করতে না পারলে মেগা প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি মিলবে না। এমনকি এই কাজ যাদের করার কথা সেই সিটি করপোরেশনও গত এক দশকের প্রচেষ্টায় ওই ২১ খালের সংস্কারে কোনো প্রকল্প নিতে পারেনি।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের ৫৭টি খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কাজ চলছে ৩৬ খালের। যার দৈর্ঘ্য ৯৭ কিলোমিটার। প্রকল্পের বাইরে থাকা বাকি ২১ খালের দৈর্ঘ্য ৬৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই ২১ খাল থেকে মাটি উত্তোলনের প্রস্তাব ছিল ৪ লাখ ৫২ হাজার ঘনমিটার।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ সময়ের। কিন্তু ২০১২ সালের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতে পুরো নগর ডুবে যাওয়ার পর এই সমস্যার দিকে নজর দেয় সরকার। ওই বছর সিটি করপোরেশন একটি নতুন খাল খননের প্রকল্প গ্রহণ করলে ২০১৪ সালের ২৪ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তা অনুমোদন হয়। বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬৫ ফুট প্রস্থের এ খাল খনন প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয় ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বিভিন্ন ধাপে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৬২ কোটি টাকায়। কাজটি এখনো শেষ করতে পারেনি চসিক।
এরপর ২০১৬ সালে চায়না পাওয়ার নামে একটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো শহরের খাল-নালার সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করে চসিক। কিন্তু তার আগেই চট্টগ্রাম শহরের খাল নিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার তৈরি করা একটি ধারণাপত্রকে প্রকল্প বানিয়ে অনুমোদন করে নিয়ে আসে সিডিএ। এরপর থেকে আর কোনো খাল নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি সংস্থাটি। তাই মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খাল সংস্কার কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।
সম্ভাব্যতা যাচাইও করতে পারেনি চসিক
২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গৃহীত কার্যক্রমের একটি পর্যালোচনা সভা হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় ২১ খাল নিয়ে চসিকের প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০২৩ সালে ২১টি খালের উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। দরপত্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে আনার চেষ্টা করলে তারাও আসেনি।
পাওয়ার চায়নার কাছে আবারও দ্বারস্থ
২০১৬ সালে পাওয়ার চায়না একবার পুরো শহরের খালগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। তাদের আশা ছিল জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজটি তারা করবে। কাজ পাওয়ার আশায় এটা ছিল তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ। কিন্তু সিডিএ প্রকল্প নিয়ে নেওয়ায় তারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এখন ৯ বছর পর তারা আবারও শহরের একাংশের খালের নতুন করে সংস্কার কাজের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজের সুযোগ পাচ্ছে। তারা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রকল্পের ডিপিপিও তৈরি করবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, রাজধানীর একটি হোটেলে চীনের প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার রেন হাও- এর সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। চীনা প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম শহরের ২১টি খালের সংস্কার কাজ করতে এখনো আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাওয়ার চায়না জি টু জি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী।’
ডা. শাহাদাত বলেন, ‘পাওয়ার চায়না সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের মেয়াদকালে একবার স্টাডি করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা আছে। তারপরও তাদের নতুন করে ২১টি খাল নিয়ে স্টাডি করতে বলেছি। স্টাডি শেষে তারা ডিপিপি প্রস্তুত করবে। প্রতিটি খালের পুরোনো রেকর্ড ঘেঁটে ‘আসল খাল’ বের করা হবে। এতে চসিকের কোনো অর্থ খরচ হবে না। কারণ কাজটি সরকারি অর্থায়নে হবে।’
চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিডিএফ) মুখপাত্র মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যেখানে এক যুগে একটি খালের কাজ করতে পারেনি, সেখানে তারা ২১টি খালের কাজ করতে পারবে- এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তারপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা তাদেরকে সক্ষম হিসেবে দেখতে চাই। তাদেরকে সফল হিসেবে দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘সিডিএ ৩৬টি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে। বাকি খালের উদ্যোগ সিটি করপোরেশন নিতে পারতো। সরকার যেখানে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ করছে, সেখানে ২১টি খালের সংস্কার কাজের জন্য টাকা দেবে না- এটা বিশ্বাস করতে চাই না। আমার ধারণা, সংশ্লিষ্টরা সরকারের কাছে বিষয়টি যথাযথভাবে উত্থাপন করতে পারেননি।’
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও নগরবিদ প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিয়ে মূল কাজ করছে সিডিএ এবং সিটি করপোরেশন। দুই সংস্থার উচিত ছিল বাদ পড়া বাকি ২১ খাল হয় মেগা প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা, অথবা নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা। তারা এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে মেগা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও নগরবাসী এর সুফল পুরোপুরি পাবে না।’
চট্টগ্রাম নগরের যত খাল
সিইপিজেড আনন্দবাজার খাল, হোসাইন আহমেদ পাড়া খাল, চরপাড়া, ভাটিয়ারির ধামাইর খাল, চট্টেশ্বরী খাল, কৃষ্ণখালী খাল, ১৫ নং ঘাট এয়ারপোর্ট খাল, বালুখালী খাল, রামপুর খাল, কুয়াইশ খাল, উত্তর সলিমপুরের বারিঙ্গাছাড়া খাল এবং ফরেস্ট খাল। এ ছাড়া নেভাল অ্যাকাডেমি, সিইপিজেড নতুন পাড়া, উত্তর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, লতিফপুর এবং সলিমপুরের স্লুইস গেটের ১১টি সংযুক্ত খাল রয়েছে।