
২০১০ সালের ৩ জুন। পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনটি বিয়ের আয়োজনে ঝলমল করছিল। চারদিকে ছিল আনন্দ আর হই-হুল্লোড়। কিন্তু হঠাৎ এক বিস্ফোরণ, তারপরেই ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আর্তনাদ আর কান্নার রোল শোনা যেতে থাকে। কারণ মুহূর্তে কেমিক্যালের সংস্পর্শে দ্রুতই ছড়িয়ে যায় আগুন। আগুন যখন নিভল, ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে ছিলেন ভবনটির মালিক গোলজার এলাহীর পরিবারেরই ১১ জন।
সেই ১১ স্বজন হারানোর ব্যথা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন গোলজারসহ বেঁচে থাকা স্বজনরা। কেবল এই পরিবারটি নয়, সেই রাতের ভয়াবহতায় যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের স্বজনরা এখনো বুকে কষ্ট নিয়ে সময় পার করেন। আজ সেই নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর পূর্ণ হলো।
দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে বছরও চলে যায়, কিন্তু স্বজনহারাদের কষ্ট যায় না। গত রবিবার নিমতলী গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা এই ভবনসহ আশপাশের যে বাড়িগুলো পুড়েছিল, তা এখনো দেখে চেনার উপায় নেই। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো মেরামতের পর রং করা হয়েছে। ওই দিন যারা দগ্ধ হয়েছিলেন, তাদের পোড়া ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুতেই সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না । এখনো তারা দুচোখের পানিতে বুক ভাসান। ওই ভবন ঘেঁষে পশ্চিম পাশে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নিমতলী এলাকায় কর্মচঞ্চল মানুষের এখনো অনেক ব্যস্ততা। দোকানপাট ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মানুষের জটলা রয়েছে যথারীতি আগের মতোই।
এলাকাবাসী জানান, সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখানে ৫টি বাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়িগুলো মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনা এখনো তারা ভুলতে পারেননি।
তাদের দাবি, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ঘটনার পর সরকার ও প্রশাসনের লোক তৎপর হলেও এখন আর কেউ দেখতে আসে না তাদের সমস্যা।
নবাব কাটরার ‘দিনসাবেরা’ নামে ওই পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল বা রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই ভয়ংকার দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন ভবনমালিক গোলজার। পরিবারের ১১ সদস্য হারানোর ব্যথা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
গোলজার বলেন, ‘আমার স্ত্রী, দুই সন্তান, মেজো ও ছোট ভাইয়ের পরিবারের ৬ জন এবং আমার মা ও চাচি আগুনে পুড়ে মারা যান। ১৫ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন আমাদের বাসার এক ভাড়াটের একটি বিয়ের আয়োজন ছিল। বিয়ের রান্না হচ্ছিল বাসার নিচে। ওই দিন আমি ও আমার মেজো ভাই মোহাম্মদ দিদার বাসার বাইরে ছিলাম। দুই ছেলের কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে বাজারে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খবর পাই বাড়িতে আগুন লেগেছে। দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে দেখি পুরো বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ভেতরে যারা আটকা পড়েছিলেন, তাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সেই কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে, অসুস্থ বোধ করি। সেদিন যেন ছিল লাশের মিছিল, চারদিকে পোড়া লাশের গন্ধ। ভেতরে ধোঁয়ায় আটকা পড়ে আমার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ১১ জন মারা যায়।’ বলতেই দুচোখ ভিজে আসে হাজি গোলজার এলাহীর।
গোলজার বলেন, ‘আমার যমজ দুই সন্তান ইমতিয়াজ গোলজার ও ইসতিয়াক গোলজার এবং স্ত্রী ইয়াসমিনের অনেক স্মৃতি। ১৯৯২ সালে দুই সন্তান একসঙ্গে জন্মেছিল। ওরা দুই ভাই মায়ের রান্না খুব পছন্দ করত। মায়ের হাতের তৈরি কাচ্চি ও পায়েস তাদের খুব পছন্দের ছিল। এ ছাড়া বাইরে ফাস্টফুড খেতে তারা খুব পছন্দ করত। বাইরে খেতে খুব এনজয় করত।’ বলতে বলতে চোখ মোছেন গোলজার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তাদের কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। প্রতিবছরই ওই দিনটি এলে কষ্ট আরও বাড়ে। বেঁচে থাকলে ছেলে দুটি আজ কত বড় হতো। বাবা হয়ে কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়েছে, এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কী হতে পারে?’
গোলজার জানান, পোড়া বাড়ি মেরামতের জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। প্রতিবছরই এই দিনে মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত ও তবারকের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় তিনি পরিবারের নিহত সদস্যদের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন।
গোলজারের পাঁচতলা ভবনের বিপরীত পাশেই রয়েছে একটি ইলেকট্রিক দোকান। এখানকার ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। বিদ্যুতের তার এত ঘনভাবে লাগানো যে অনেক জায়গায় জটলা বেধে থাকে। যেকোনো সময় শর্টসার্কিট হতে পারে। এ ছাড়া একটু বৃষ্টিতেই এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়। এসব দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’
প্রতিবছর আজকের এই দিনে নিমতলীবাসী কাঁদেন। স্বজন হারানোর কথা স্মরণ করে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়।