
সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। তবে বেড়েছে আমানতের পরিমাণ। চলতি বছরের মার্চ শেষে এক কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে, এমন হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৭১৯টি। একই সময়ে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কিছু সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও নেতার ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং তলব করা হয়েছে। এর ফলে বড় অঙ্কের আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই নিরাপত্তার কারণে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। এতে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা কমলেও কিছু অ্যাকাউন্টে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। তাদের মতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন একশ্রেণির মানুষের অর্থ বৃদ্ধি দেশে আয়বৈষম্য বাড়ার ইঙ্গিত। তাদের মতে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং সাম্প্রতিক সময়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আশঙ্কাজনক হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়েনি। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন অবস্থায় অর্থ জমানো দূরের কথা, অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এই সময় দেশের একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। এরা হচ্ছেন পুঁজিপতি, বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল, এখন আরও বেড়েছে। মূলত আয়বৈষম্যের কারণেই দেশের কোটি টাকার আমানত বাড়ছে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও আয়বৈষম্য বাড়ায়। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষের বৈধ-অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, সেখানেও আয়বৈষম্য কমানোর কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোরও কোনো পদক্ষেপ নেই। এই অবস্থায় আয়বৈষম্য কমাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর অনেক মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এতে অনেক আমানতকারী তাদের আমানত সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে কোটিপতি আমানতধারীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে এসব হিসাবে রাখা আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। এটা সমাজের আয়বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার একটা অন্যতম দৃষ্টান্ত। দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই এই আয়বৈষম্য বাড়ছে। তাই বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো না গেলে সামনে এটা আরও বাড়তেই থাকবে।’
একই বিষয়ে গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে কর কাঠামোতে যে কয়েকটি স্তরের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও বড় ধরনের বৈষম্য করা হয়েছে। অর্থাৎ নিম্নবিত্তদের বেশি ও উচ্চবিত্তদের কম কর দিতে হবে। যদিও বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত ছিল রাজস্বনীতির মাধ্যমে আয় বৈষম্য কমানো।
প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ৭১৯টি কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি হিসাবগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে কোটিপতি হিসাবগুলোর আমানত বেড়েছে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে হিসাব ও আমানতের সংখ্যা বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টি, আর মার্চ শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬৮ হাজার ৮২১টিতে। একই সময়ে আমানতের পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে হিসাব বেড়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৬০ হাজারটি। আর আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোটিপতি হিসাব মানেই তা ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। এসব হিসাবের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং একজন ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। ফলে হিসাবের সংখ্যা কমার অর্থ ব্যক্তি কোটিপতির সংখ্যা কমেছে, তা নির্ধারণ করা যায় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালে দেশে কেবল ৫ জন কোটিপতি হিসাবধারী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তা বেড়ে হয় ৪৭ জন। এরপর ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮টি, ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি এবং ২০০৮ সালে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের শেষে এ সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তা হয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৮১টি, যা মার্চে নেমে আসে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টিতে।