
সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর। এখানকার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার বাসিন্দা আবদুল হালিম আগে নিজের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। সংসার চলত কোনোমতে। কিন্তু এখন তার জমিতে অন্যরা মাছ চাষ করেন। বছর চুক্তিতে জমি ভাড়া দিয়ে টিকে আছেন খুব কষ্টে।
তিনি বলেন, ‘গাবুরা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদী থাকায় খুব সহজে লবণ পানি কৃষিজমিতে প্রবেশ করে। লবণ পানি যে বছর জমিতে প্রবেশ করে, পরবর্তী তিন-চার বছর ওই জমিতে আর কোনো ফসল হয় না। নিজেরও কয়েক খণ্ড আবাদি জমি ছিল, কিন্তু প্রতিবছর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও লবণাক্ততার কারণে ওই জমিগুলোকে বছর চুক্তিতে অন্যকে দিয়েছি। সেখানে বর্তমানে চিংড়ির ঘের করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমি ব্যবসা করি, আর আমার মতো শত শত কৃষক এই অঞ্চলে রয়েছেন, যারা বর্তমানে পেশা পরিবর্তন করেছেন।’
পার্শ্ববর্তী পাতাখালী গ্রামের মাসুম বিল্লাহ বলেন, একটা সময় এলাকার অধিকাংশ জমিতেই ফসল উৎপাদন করা হতো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে সেই জমিগুলো রূপ নিয়েছে মৎস্যঘের আর পতিত জমিতে। কারণ সেখানে একে তো লবণ পানিতে ফসল হয় না, তার ওপর কয়েক বছর ধরে যেভাবে তাপপ্রবাহ হচ্ছে তাতে করে মাছে মড়ক লেগেছে। তাই বাধ্য হয়ে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে।
শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, এই ইউনিয়নে বসবাসরত ৪৭ হাজার মানুষের অধিকাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষিজমি নষ্টসহ কর্মসংস্থান না থাকায় জেলার অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানে বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্ব। অতিমাত্রার লবণাক্ততার কারণে পতিত রয়েছে শত শত বিঘা জমি। ঘন ঘন দুর্যোগে সহায়-সম্পদ হারিয়ে পেশা বদলাচ্ছেন বহু মানুষ।
লবণে শেষ কৃষি ও মৎস্য
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাতক্ষীরার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির ৮১ শতাংশেরও বেশি এখন লবণাক্ত। আর পতিত জমি রয়েছে ৪০ হাজার ৯৮১ হেক্টর। জেলার উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনবেষ্টিত শ্যামনগর উপজেলা। এই উপজেলার ৩৭ হাজার ১৪৬ হেক্টর আবাদি জমির প্রায় সাড়ে ৯৯ শতাংশ জমি লবণাক্ত হওয়ায় চাষাবাদও কমেছে। এ ছাড়া সদর উপজেলায় ২৯ হাজার ৩১৯ হেক্টর আবাদি জমির প্রায় ৬৩ শতাংশ, কলারোয়ায় ১৭ হাজার ৪২১ হেক্টর জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ, তালায় ২৮ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমির প্রায় ৬৪ শতাংশ, দেবহাটায় ১৪ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমির ৬১ শতাংশ, কালীগঞ্জে ২৬ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জমির ৯৬ শতাংশসহ আশাশুনি উপজেলায় ৩৪ হাজার ৪৫৬ হেক্টর আবাদি জমির ৯৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্রে জানা যায়, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণের দেখা মিলছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার খাজাবাড়িয়া এলাকার বোরো চাষের জমিতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস পর্যন্ত লবণ পাওয়া গেছে। মাটিতে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ ২ ডেসিসিমেন (ডিএস)/মিটারের বেশি হলে তাকে লবণাক্ত মাটি বলে।
এ ছাড়া ওই এলাকায় ভূগর্ভের পানিতে লবণের উপস্থিতি ২৫ ডিএসের বেশি। ফলে ২০২৪-২৫ মৌসুমে বোরো ধান গবেষণা প্রকল্পের অধীনে পরীক্ষামূলক ধান চাষে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি।
অন্যদিকে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৯ হাজার লবণ পানির ঘের রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। আর জেলার মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়। তবে কয়েক বছর ধরে প্রায় ঘেরেই বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। এতে জেলার চাষিরা আর্থিকভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ হিসেবে জলবায়ু বিপর্যয়কে দায়ী করে অধিদপ্তরটি।
কালীগঞ্জ উপজেলার কামারগাতি গ্রামের বোরোচাষি ফজর আলী জানান, চলতি মৌসুমে তিনি তিন একর জমিতে বোরো চাষ করেন। কিন্তু জমিতে অতিমাত্রার লবণের কারণে বোরো ধানের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হয়নি। খেতের ২০-৩০ শতাংশ ধানগাছ লবণের কারণে শুকিয়ে যায়। এর ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
শ্যামনগর উপজেলার গুমানতলী এলাকার চিংড়িচাষি ইব্রাহিম খলিল বলেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি বাগদা চিংড়ির চাষ করেন। এবারও ১০ বিঘা লবণ পানির ঘেরে ৪৫ হাজার বাগদার পোনা ছেড়েছেন। এখন প্রতিটি বাগদার ওজন ৪০ গ্রাম করে। কিন্তু তীব্র এই গরমে বাগদা চিংড়িতে মড়ক লেগে মারা যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ওই মড়কের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
একই এলাকার রাজু আহম্মেদ জানান, গত মৌসুমে ২০০ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছিলেন তিনি। সেবার প্রথম কোটার অবমুক্ত করা বাগদা মরে গেছে। এতে তার প্রায় ৩ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়। সে ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনননি তিনি।
রাজু বলেন, প্রচণ্ড গরম, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ অনাবৃষ্টির কারণে তার মতো এ অঞ্চলের প্রায় সব মৎস্যঘেরের একই দশা। এলাকার অধিকাংশ ঘেরে পর্যাপ্ত পানি নেই।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম জানান, বাগদা চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর লবণসহিষ্ণু মাত্রা হলো সর্বোচ্চ ২৫ পার্টস পার থাউস্যান্ড (পিপিটি)। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি চিংড়ি চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন তা ঘেরগুলোতে নেই। এ কারণে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে গরমের কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, চাষিরা মৎস্য বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী ঘের পরিচালনা করলে এই ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরার সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষিতে। লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে পাঁচ বছরের মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলে পরিবেশের যেমন মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে, তেমনি ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক ক্ষতি হবে। এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে বৃক্ষরোপণ, পুকুর ও জলাশয় তৈরির কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সামছুন নাহার জানান, ২০২২-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৫ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকার জমিতে লবণের উপস্থিতি দ্বিগুণ হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলায় ২০২২ সালে লবণের উপস্থিতি ছিল ৪ দশমিক ১ ডিএস পরিমাণ। সেখানে চলতি বছর সর্বশেষ জরিপে লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ১০ দশমিক ৯ ডিএস মাত্রায়। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট লবণাক্ততার যে মাত্রা পেয়েছে সেটা খুবই ভয়াবহ। ২৫ ডিএস মাত্রায় লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেলে তা যেকোনো ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, উপকূলীয় এলাকার কৃষিজমির পাশাপাশি ভূগর্ভের পানিতেও অতিমাত্রার লবণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে ওই সব এলাকার কৃষকদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বোরো চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া জেলা মাসিক সমন্বয় সভার মাধ্যমে বিলের মধ্যে সরকারি খালগুলো উন্মুক্ত করার পাশাপাশি জলাশয় ও পুকুর বা দিঘি খননের সুপারিশ করা হচ্ছে।