
লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ আবেদনকারীদের হয়রানি এখন চরমে পৌঁছেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- দালালের সহযোগিতা ছাড়া এ অফিস থেকে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দালালচক্রের যোগসাজশ থাকায় আবেদনকারীদের নানা ধরনের ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, সঠিক কাগজপত্র থাকার পরও আবেদন গ্রহণে টালবাহানা, অনৈতিক অর্থ দাবি এবং কাজের দীর্ঘসূত্রিতা এই অফিসে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এক মাসের পাসপোর্ট হাতে পেতে তিন মাসও লেগে যাচ্ছে। এতে করে অনেকের ভিসা বাতিলসহ আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের মোহাম্মদ তারেক জানান, তার পাসপোর্টের আবেদনপত্রে ওয়ার্ড নম্বরে সামান্য ভুল ছিল। ওই আবেদন বাতিল করতে এক সপ্তাহ ধরে অফিসের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু তিন হাজার টাকা দিয়ে একজন দালালের মাধ্যমে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তার আবেদন বাতিল করা সম্ভব হয়।
একই উপজেলার দাউদপুর গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, দালাল ছাড়া তিনি নিজেই পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন। তার মায়ের নামের ইংরেজি বানানে একটি বর্ণের ভুল থাকায় তার আবেদন তিন মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়। একাধিকবার উপ-পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেও কোনো সমাধান পাননি। পরে দালালের শরণাপন্ন হয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে বাধ্য হন।
জয়পুর গ্রামের গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘আমার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রে একটি বর্ণ ভুল ছিল। এ কারণে ২১ দিনে পাওয়ার কথা থাকলেও পাসপোর্ট পেতে তিন মাস পার হয়ে যায়। তিনবার উপ-পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেও লাভ হয়নি। অবশেষে তিন হাজার টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট পাই।’
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পাসপোর্টের আবেদন ফরমে ওই অফিসের তালিকাভুক্ত দালালের সাংকেতিক চিহ্ন থাকতে হয়। অথবা দালালের পাঠানো মোবাইল মেসেজের তালিকায় নাম থাকলে যত ত্রুটিই থাকুক না কেন পাসপোর্ট পেতে কষ্ট হয় না। পাসপোর্ট অফিসসংলগ্ন কম্পিউটার দোকানগুলোর মালিক-কর্মচারীরা এই দালাল সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। এ ছাড়া রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর, রামগতি, চন্দ্রগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৫০ জন সক্রিয় দালাল রয়েছে, যারা পুরো অফিসটি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া খুবই কঠিন।
ওই সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য দালালরা কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে থাকেন। আর তারা আবেদনকারীর কাছ থেকে আদায় করেন তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলে ওই অঙ্ক পৌঁছে ৪০ হাজারের ঘরে।
দালালদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে, র্যাব-১১-এর একটি বিশেষ দল গত তিন মাস আগে অভিযান চালিয়ে ১২ দালালকে আটক করে পুলিশে দেয়। তবে জামিনে মুক্ত হয়ে তাদের অনেকেই এখনো দালালি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ নাগরিকরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিসে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো জরুরি। নয়তো দালাল-প্রভাবিত এই অচলাবস্থা চলতেই থাকবে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক এসএম জাকির হোসেন বলেন, ‘এ অফিসে কোনো দালাল নেই। কেউ হয়রানির শিকার হচ্ছেন না। আমরা বিধি মোতাবেকই সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা সরাসরি দালালদের সহযোগিতা করছেন। তাদের না জানালে কিংবা আর্থিক লেনদেন না করলে কোনো আবেদনই সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। দুদকের চাঁদপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের একটি দল এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি ওই অফিসে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী তদন্ত চালালেও অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার আখতার হোসেন বলেন, ‘গত কিছুদিন আগে লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দালালদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালিয়ে কয়েকজন দালালকে আটক করেছিল। দালালদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধ ও পাসপোর্ট সেবাপ্রত্যাশীদের হয়রানি বন্ধে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে।’
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার জানান, তিনি এ বিষয়ে অবগত নন। অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।