
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ পর্যন্ত বকেয়া পাওনা ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে বুধবার (১৮ জুন) পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি ৮৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেছেন, চলতি অর্থবছর শেষে ঘাটতির রেকর্ড হতে পারে। অন্যদিকে বকেয়া আদায় হলে রাজস্ব ঘাটতি হবে না, বরং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হবে।
রেকর্ড ঘাটতি এড়াতে এনবিআর থেকে এরই মধ্যে ৫০ লাখ টাকার বেশি বকেয়া আছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ৩০ জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে এনবিআর। প্রয়োজনে হিসাব জব্দের মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে।
এনবিআর প্রণীত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বকেয়া রাজস্বের বেশির ভাগই সম্পদশালী ব্যক্তি ও বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকা রয়েছে। বকেয়া পরিশোধে এনবিআর থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই পরিশোধ করছে না।
অনেকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে একটি অর্থও রাজস্ব বাবদ জমা দেন না। প্রায় প্রত্যেকে বকেয়া পরিশোধে সময় বাড়ানোর আবেদন করে থাকে। বারবার সময় বাড়নোর পরও পরিশোধ করেন না। অনেকে মামলা করে আদায় প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছেন। এসব রাজস্ব মামলা কবে নিষ্পত্তি হয়ে কবে রাজস্ব আদায় সম্পন্ন হবে তা অনিশ্চিত। অনেক মামলা এক যুগের বেশিও সময় ধরে চলমান রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও আছে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রাজস্ব পরিশোধ না করলে বা হিসাবের চেয়ে কম পরিশোধ করলে এনবিআর প্রকৃত পাওনা হিসাব কষে বের করে। এরপর হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেয়। এভাবে কয়েক দফা সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও পাওনা রাজস্ব পরিশোধ না করা হলে এনবিআর আপিলাত টাইব্যুনালে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য যায়। এখানে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষের শুনানি, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন চলতে থাকে। এতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। এখানে রাজস্ব পরিশোধ করতে রায় দেওয়া হলে ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান সাধারণত আদালতে গিয়ে মামলা করে থাকেন। এখানে মামলার শুনানির তারিখ পড়ে। বাদী-বিবাদী দুই পক্ষ যে যার যার পক্ষে যুক্তি, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকেন। এভাবে অনেক মামলা ৮ থেকে ১০ বছর বা বেশি সময় ধরে চলমান আছে।
রাজস্ব অর্থনীতির বিশ্লেষক এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পাওনা রাজস্বের জন্য এনবিআর চাপ দিতে পারে না। অনেক ব্যবসায়ী এই সুযোগ নিয়ে থাকেন। তাই অনেকেই বকেয়া পরিশোধ না করে একটা মামলা করে আদায় প্রক্রিয়া আটকে রাখেন। বছরের পর বছর মামলার শুনানি চলতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, ‘১০ থেকে ১২ বছর আগে করা রাজস্ব মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি- এমন নজিরও আছে। বাংলাদেশে মামলা নিষ্পতিতে বেঞ্চের সংখ্য তিন থেকে চারটি। আমার জানামতে, বর্তমানে অনিষ্পন্ন রাজস্ব মামলা হাজার হাজার। এসব মামলা কবে নাগাদ নিষ্পত্তি হবে, তা অনিশ্চিত। বকেয়া আদায় করা সম্ভব হলে এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি হবে না। বরং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হবে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রাজস্ব মামলার সংখ্যা ২৭ হাজারের বেশি। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে রাজস্ব খাতে সরকারের আদায় হবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া বকেয়া রাজস্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে ভ্যাট। এনবিআরের মাঠপর্যায়ের ১২টি অফিসে বকেয়ার মারপ্যাঁচে আটকা আছে ২৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা আদায় করতে দিনের পর দিন চিঠি চালাচালি চলছে। এমনকি পাঁচ বছরের বকেয়া টাকাও আটকা আছে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) পাওনা সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগের পাওনা ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এনবিআরের মাসিক সমন্বয় সভাগুলোতেও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও বকেয়া আদায়ে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালকে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে গত ১১ মাসে (জুলাই-মে) রাজস্ব ঘাটতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে প্রায় ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ভ্যাট খাতে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অর্থবছরের মাঝামাঝি বড় অঙ্কের ঘাটতির মুখে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি ধার্য করা হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআরকে অর্থবছরের শেষ মাস জুনে মোট ১ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, এনবিআর অতীতে কখনো এক মাসে এত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে কাজ করেনি।’
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। এত বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড এনবিআরের নেই।
অর্থবছরের শুরু থেকেই এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে ছিল, সময়ের সঙ্গে সেই ব্যবধান আরও বেড়েছে। ফলে বছর শেষে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতির কারণ হিসেবে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ি করেছে এনবিআর। সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ধীরগতির কারণেও রাজস্ব আদায়ের গতি কমেছে। আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে ব্যাঘাত ঘটেছে, আয়কর খাত থেকেও প্রত্যাশিত হারে রাজস্ব আদায় হয়নি। সর্বশেষ এনবিআর বিলুপ্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনও টার্গেট পূরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।