
২০২৩ সালের ঘটনা। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে শ্যামনগরের ১৫ যুবক স্থানীয় এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ইতালিতে যেতে চুক্তিবদ্ধ হন। জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা দেওয়ার বিনিময়ে আকাশপথে আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়ায় কিছুদিন থাকার পর সেখান থেকে সাগরপথে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল।
তবে লিবিয়ায় নেওয়ার পর তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর অমানুষিকভাবে নির্যাতন করা হতো টাকার জন্য। এভাবে ১৮ মাস একটা রুমের ভেতরে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় পাচারকারীরা। মুক্তিপণ দিয়েও মুক্তি মেলেনি অনেকের। তাদেরই একজন জামিরুল ইসলাম। অপহরণকারীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান তিনি।
এই ১৮ মাস নির্মম নির্যাতন সইতে হয়েছে বাকিদেরও। দফায় দফায় দিতে হয়েছে মুক্তিপণের টাকা। একপর্যায়ে পাচারকারীদের দাবি করা জনপ্রতি ১৮-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরেন পাচারের শিকার মামুন কয়াল, আজিজুল ইসলাম, বাবলু মোল্ল্যা, রহিম হোসেন, রাশিদুল ইসলাম, সামাদ গাজী ও করিম গাজী। টাকা দিতে না পারায় দেশে ফিরতে পারেননি দেলোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, রায়হান হোসেন, মিজানুর রহমান, রফিকুল ইসলামসহ ৭ জন।
যারা ফিরেছেন তারা কাজ করার সক্ষমতা হারিয়েছেন। মুক্তিপণের টাকা জোগাড়ে জমিজায়গা বিক্রিও করেছেন। জমির লবণের মতোই নিজের জীবনকেও বিষাক্ত মনে হয় মামুন কয়ালের।
অনুসন্ধানে যা জানা গেল
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার মানুষের দারিদ্র্য যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে কর্মসংস্থানও। এতে এই অঞ্চলের মানুষ থাকে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে। সেই ঝুঁকি মোকাবিলা এবং সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে একসময় তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেই সুযোগে পাচারকারীরা বিদেশে পাঠানোর টোপ ফেলে এসব ঋণগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষর সামনে। তাদের প্রলোভনে পড়ে এসব উপকূলীয় এলাকার মানুষ মানব পাচারের শিকার হন।
মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এবং পাচারের শিকার হওয়া সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার অর্ধশতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে খবরের কাগজ। সবার দাবি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা দালালদের প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার হয়েছেন। বিদেশ যেতে আগ্রহী এমন অনেক নারী ও পুরুষের সঙ্গেও কথা বলে খবরের কাগজ। যাদের অনেকে বডি কন্ট্রাক্ট হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। বডি কন্ট্রাক্ট বলতে গন্তব্য দেশে পৌঁছানোর পর চুক্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়, তার আগে যাবতীয় খরচ দালাল বহন করেন। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সাতক্ষীরা অঞ্চলে বডি কন্ট্রাক্টে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।
পাচারের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসা ওই ১৫ জন শ্রমিকের অধিকাংশ কোনো ধরনের দক্ষতা ছাড়াই বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশের ধারণা ছিল, তারা বিদেশে গিয়ে কাজ করতে করতে শিখে নেবেন বা দক্ষ হবেন। অভিবাসনে লাভ/ক্ষতি বলতে তারা কাজের মেয়াদ (মাস), মাসিক মজুরি (টাকা), মোট আয় (টাকায়), সর্বমোট অভিবাসন ব্যয় বা বিনিয়োগকে (টাকায়) বোঝেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধ (সুদসহ), পারিবারিক বা সাংসারিক ব্যয়, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, অভিবাসী কর্মীর বিদেশে জীবনযাপনের ব্যয়, সঞ্চয় ইত্যাদি ব্যয় গণনায় নিয়ে আসেননি।
গবেষণা যা বলছে
জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলে মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ২০২৩ সালে সাতক্ষীরার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও কৈখালী ইউনিয়নের ওপর পরিচালিত ওকাপের (অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম) এক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলের ৫৯ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়েছেন। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ অভিবাসী জীবিকার সন্ধানে বিদেশে অভিবাসনের পথ বেছে নিয়েছেন। বাকি ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশেই অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন জেলায় পাড়ি জমিয়েছেন। আর সেখান থেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে মানব পাচারের শিকারে পরিণত হন তারা। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে মানব পাচার হওয়ার মোট আটটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। পাচার হওয়া মানুষের ৫১ শতাংশই জীবিকার কারণে পাচারের শিকার হচ্ছেন।
মানব পাচার ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় ইউএনওডিসির এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
পাচার হচ্ছেন নারীরাও
সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা জামেলা খাতুন (৩৪) (ছদ্মনাম)। উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্নে ২০১১ সালে দালালের খপ্পরে পড়ে ২০ বছর বয়সে লেবাননে পাচারের শিকার হন তিনি। টানা তিন বছর কাজ করেও বেতন পাননি। বরং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাকে। জামেলার ভাষায়, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাস তার। তার এলাকায় বন্যা হয়, ঘরবাড়ি নষ্ট হয়, ফসলের ক্ষতি হয়। এর প্রভাব পড়ে তার সংসারে সৃষ্টি হয় অশান্তি।
জামেলা খাতুন বলেন, যৌতুকের টাকার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী নির্যাতন করতেন। আমার বাবার সামর্থ্য ছিল না কিছু দেওয়ার। টাকা দিতে না পারায় আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে যায়। উপায় না পেয়ে ২০১১ সালে পরিচিত একজনের মাধ্যমে লেবাননে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমার পাসপোর্ট নিয়ে রাখা হয়। টানা তিন বছর সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও আমাকে বেতন দেওয়া হয়নি। বরং ওরা (বাসা মালিক) আমাকে বলত ‘তারা আমাকে কিনে নিছে। টাকা দিতে পারবে না।’
জামেলার মতো মানব পাচারের পাচারের কবলে পড়ে সৌদি আরবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শ্যামনগর উপজেলা সদরের বাসিন্দা সখিনা খাতুন (২২) (ছদ্মনাম)। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার ভরণপোষণ জোগাতে অপ্রাপ্ত বয়সে দালালের মাধ্যমে পাড়ি জমান বিদেশে। হাউস ভিসায় কাজের কথা থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী কাজ দেওয়া হয়নি তাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানব পাচারের যোগসূত্র
সাতক্ষীরায় মানব পাচার প্রতিরোধে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ (সিডব্লিউসিএস)। প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত। এ অঞ্চলে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় শেষ করে দিচ্ছে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে এ অঞ্চলের বহু পরিবার ঋণের ফাঁদে আটকা। আর এই সুযোগে পাচারকারীরা সহজেই তাদের উন্নত জীবনের আশায় প্রলুব্ধ করার সুযোগ পেয়ে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষকে ফাঁদে ফেলছেন।
সাতক্ষীরায় বিজিবির তিনটি ব্যাটালিয়নের অধীনে জল ও স্থল মিলিয়ে সীমান্ত এলাকা রয়েছে ২৭৮ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সীমান্তের ১০টি চোরাঘাট দিয়ে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়নের (৩৩ বিজিবি) তথ্যমতে, জেলায় গত চার বছরে (২০২১-২৪ সাল পর্যন্ত) মানব পাচারের শিকার ৩৩ জনকে উদ্ধার করেছে তারা। এর মধ্যে পুরুষ রয়েছে ৬৪ শতাংশ, নারী ১২ শতাংশ ও শিশু রয়েছে ২৪ শতাংশ। একই সময়ে সীমান্তে অনুপ্রবেশের দায়ে ২৮১ জনকে আটক করেছে বিজিবি। বিজিবির দাবি, আটককৃতদের মধ্যে অনেককে পাচারের উদ্দেশ্যে ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় দালাল চক্র। তবে অভিযানের সময় বেশির ভাগ পাচারকারী পালিয়ে যায়। ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করতে বাধ্য হয় তারা।
মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করা বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোরের তথ্যমতে, বিগত চার বছরে (২০২১-২৪) ভারতে পাচারের শিকার ২৯০ জনকে উদ্ধার করেছে তারা। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৩১ শতাংশ নারী ও ৩১ শতাংশ পুরুষ, আর শিশু রয়েছে ৩৮ শতাংশ। যাদের অধিকাংশ উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন রাইটস যশোরের প্রোগ্রাম অফিসার আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মানব পাচারের অন্যতম কারণ। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাচারের শিকার ছয় শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করেছে রাইটস যশোর।
ধীরগতির তদন্ত, বিলম্বিত বিচার
২০১৯ সালে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার হয় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১৪ বছরের এক কিশোরী। এ ঘটনায় ওই বছরের ৫ নভেম্বর সাতক্ষীরা সদর থানায় মানব পাচার আইনে একটা মামলা করেন কিশোরীর বাবা (মামলা নং ১৬/১৯)। এরপর ৪ বছর ধরে সাতক্ষীরা সদর থানার তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হন। পরে এই মামলার পঞ্চম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব পান সাতক্ষীরা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমান। দীর্ঘ ১৮ মাস তদন্ত করার পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের শেষভাগে পাচারের শিকার ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে ওই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ ও আদালতের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে মানব পাচার আইনে ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ৫টি মামলার তদন্ত শেষ হলেও বাকি ১৩টি মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় ছিল। আর সাতক্ষীরা আদালতে বিচারাধীন (২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) পেন্ডিং মামলা ছিল ১০৩টি।
সাতক্ষীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট শেখ আলমগীর আশরাফ বলেন, ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মানব পাচার আইনে করা মামলাগুলো নিষ্পত্তির নির্দেশনা রয়েছে। তবে আইনে বলা নেই নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে এর ফলাফল কী হবে? এ নিয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় সাতক্ষীরায় মানব পাচারের অনেক মামলা রয়েছে, যেগুলো বছরের পর বছর চললেও নিষ্পত্তি হয়নি।