
আজ (২০ জুন) বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘শরণার্থীদের সাথে সংহতি’। এ দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো ‘সংহতি’র প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা এবং এটি শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করা। কিন্তু প্রতিবছর শরণার্থীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাচ্ছে। চলতি বছরেও শরণার্থী পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশও ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বয়ে চলছে। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর কারণে বিদ্যমান অবকাঠামোতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ সমস্যা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস যে বাণী দিয়েছেন তাতে বলা হয়, আসুন আমরা সংহতি, সাহস ও মানবতা বেছে নিই। জাতিসংঘের মহাসচিব তার বার্তায় যুদ্ধ, নিপীড়ন ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সংহতি জানান।
বিশ্ব শরণার্থী দিবসে মহাসচিবের আহ্বান সংহতি যেন শুধুই শব্দে সীমাবদ্ধ না থাকে। তার ব্যাখ্যায় সংহতির মানে হচ্ছে- মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা বৃদ্ধি করা, শরণার্থীদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অধিকার নিশ্চিত করা, পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিনিয়োগ করা এবং শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সমান অধিকার দিয়ে তাদের সমাজে একীভূত করা।
১৯৫১ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর না করায় সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয় না। কনভেনশনে স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশ ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহন করছে। যদিও রোহিঙ্গাদের এখনো শরণার্থীর স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হিসেবেই দেখে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মাত্রা অকল্পনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বজুড়ে ১২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছেন। সংস্থাটি আরও জানায়, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সংঘাত, তীব্রতর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং চলমান সংকট ২০২৫ সালে আরও বাস্তুচ্যুতি ও দুর্ভোগ বাড়াবে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বছর জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত এবং রাষ্ট্রবিহীন মানুষের সংখ্যা ১৪ কোটিতে উন্নীত হতে পারে বলেও শঙ্কা করছে এই সংস্থাটি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল চেয়েছে সংস্থাটি।
শরণার্থীসংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশগত সমস্যা, অর্থনৈতিকসংকট এবং লিঙ্গ ও যৌন অভিমুখিতার কারণে সৃষ্ট সমস্যা। এসব সমস্যা নিরসন কীভাবে করা যায়, সে জন্য বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে কাজ করছে জাতিসংঘ। কিন্তু সমাধানের নজির তেমন নেই। ফলে, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে শরণার্থীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫২ শতাংশ সিরিয়া, ইউক্রেন এবং আফগানিস্তান থেকে এসেছে। ইরান বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী আশ্রয় দানকারী দেশ, যেখানে প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন শরণার্থী রয়েছে। তুরস্ক প্রায় ৩.১ মিলিয়ন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৫ লাখের বেশি শরণার্থী প্রবেশ করেছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী।
আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশনে এবং শরণার্থীবিষয়ক ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর না করেও ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহায়তায় তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ না চাইলেও বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আলোচনায় বাংলাদেশের নাম অনিবার্যভাবে এসে পড়ে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘ কাজ করলেও এর সমাধানের গোড়ায় এখনো যেতে পারেনি। উল্টো রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে। ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই সমস্যার আট বছর অতিবাহিত হলেও এর সমাধান নিয়ে কোনো উপায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের কাছে নেই।
২০১৭ সালের পর একটা বিরাটসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেনোসাইড থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই শরণার্থীবিষয়ক আলোচনায় বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের নামও এখন সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ২০১৭ সালের আগে রোহিঙ্গারা এ দেশে ছিল না, বিষয়টি তা নয়। এর আগেও ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থল ছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু ২০১৭ সালের পর বিষয়টির তীব্রতা, ভয়াবহতা এবং গুরুত্ব ভিন্নমাত্রা নেওয়ায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও শরণার্থীবিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশের নাম বিশেষ গুরুত্ব পায়। কেননা, শরণার্থী বসবাসের ঘনত্বের বিবেচনায় কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং এখন সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ের জেনোসাইডের উদাহরণ হিসেবেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসে।
ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করি, যেখানে নৃশংসতা এবং অবিরাম সংঘাত জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে এবং নিরাপত্তার খোঁজে মানুষ মরিয়া হয়ে এদিক-সেদিক ছুটছে। সেই তুলনায় মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি খুবই অপ্রতুল, কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিতেও পারি না।