
মধ্যপ্রাচ্যে আন্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা ব্যাপক হয়ে ওঠে। তখন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানো আর আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে দেখা দেয় সংঘাত।
মধ্যপ্রাচ্যের আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এমনকি চীনও। মিসরীয় বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত মার্কসীয় রাজনীতি বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ সমির আমিন বলছেন, চার কারণে মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের কবজায় রাখতে চায় শক্তিধর দেশগুলো: (১) তেলসম্পদ, (২) পুরোনো দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তে এককভাবে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখা, (৩) আরব রাষ্ট্রগুলোর দুর্বল অবস্থান এবং (৪) ইসরায়েলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে পুরো অঞ্চলকে পদানত রাখা।
সবকিছু ছাপিয়ে তেলসম্পদের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যকে সামরিক দিক থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ। মুসলিম বিদ্বেষ ও বিরোধিতার কারণে এই অঞ্চলের কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানকেও দমন করা হয়েছে। পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনে রেখেছে ভূমিকা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের ইতিহাস গভীরভাবে সম্পর্কিত। তখন থেকেই জায়নবাদের সঙ্গে আরব জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব তীব্র হতে থাকে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার চেষ্টা হলে এই সংঘাত জাতিগত সংঘাতে রূপ নেয়।
ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ইউরো-মার্কিন ভূমিকা থাকায় পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরব জাতীয়তাবাদবিরোধী। পশ্চিমা শক্তিগুলো আরব জাতীয়তাবাদকে কখনো সহজভাবে গ্রহণ করেনি। ইসরায়েলকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় সংঘাত আর পশ্চিমের আরব জাতীয়তাবাদবিরোধী তৎপরতা। তাদের কারণেই আরব রাষ্ট্রগুলোতে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৪৯ সালে সিরিয়ার সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাত করতে যোগসূত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর। ১৯৫৩ সালে ঘটে ইরানে দ্বিতীয় সেনা অভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী ছিল যুক্তরাজ্য। ইরানি সেনাদের দিয়ে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের নির্বাচিত জনপ্রিয় সরকারের জায়গায় রেজা শাহ পাহলভির রাজতান্ত্রিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তুলতে সাহায্য করা হয়। সরকার গঠন করেন জেনারেল ফাজলোল্লাহ জাহেদি। ইরানের ওপর পশ্চিমি আধিপত্যের সেই শুরু।
১৯৫৭-৫৮ সালে সিরিয়া ও মিসর একীভূত হওয়ার উদ্যোগ নেয়। পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এটা ছিল মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কিন্তু এতেও বাদ সাধে পশ্চিমের পরাশক্তিধর কয়েকটি দেশ। ‘বাগদাদ চুক্তি’র নামে এই অঞ্চলের রাজতন্ত্রকে একত্রিত করা হয়। পুরো অঞ্চলে দাঙ্গা বেধে যায়। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের জাতীয়তাবাদী উদ্যোগকে নস্যাৎ করার জন্য জর্ডান ও লেবাননে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির উসকানি দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৪ হাজার সেনা লেবাননে অনুপ্রবেশ করে। মূল লক্ষ্য ছিল, এই অঞ্চলের কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে মাথা তুলতে না দেওয়া।
ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর পরাশক্তিগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ঠিক এ সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে আরব রাষ্ট্রগুলো আত্মনিয়ন্ত্রণের ভাবনা থেকে জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করে। মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকে এরই প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরাকের ডানপন্থি বাথ পার্টি ক্ষমতায় এলেও তা মাত্র ৯ মাস স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি ইরাকের তেলসম্পদকে জাতীয়করণ করেন। এর এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় কুর্দিরা আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে ইরান-ইরাক সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। কুর্দি বিদ্রোহীদের এ সময় ১৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। কিন্তু কাজ ফুরিয়ে গেলে কুর্দিদের ওপর থেকেও হেনরি কিসিঞ্জার তার সমর্থন তুলে নেন।
১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসানের পর স্ট্যালিনিস্ট পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় এলে আবার অস্থিরতা শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আফগানিস্তানের গভীর সম্পর্কের কথা ভেবে সিআইএ অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদ্রোহী মুজাহেদিনদের গড়ে তোলে। কথিত আছে, এই সময় তাদের হাতে ৩ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। গৃহযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ আফগান মারা যান, ৫০ লাখ উদ্বাস্তু হন।
১৯৭৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে শাহের পতন হলে ক্ষমতা গ্রহণ করেন ইরানের ধর্মীয় নেতা রুহুল্লা খোমেনি। পরের বছর ইরাক আক্রমণ করে ইরান। পশ্চিমা দেশগুলো দুই দেশকেই যুদ্ধ প্রলম্বিত করার সুযোগ দেয়, যাতে তারা পারস্পরিক সংঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় দ্বিমুখী কৌশলী নীতি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ইরাক-ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ইরাককে সমর্থন দিয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে ইরাককে ক্ষমতাশালী করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট তখন বলেছিলেন, ‘কী ঘটছে, তার জন্য আমি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইব না।’ কিন্তু ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টে যায়। ইরাকের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামের সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু করে। আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম ‘হাইটেক’ বা প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধ। প্রায় ২ লাখ ইরাকি এই যুদ্ধে মারা যান। তখন ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল যে দেশটির কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এখন ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা একই ধরনের অভিযোগ করছে।
বাস্তবে ইরাকই হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ভালো তেলসমৃদ্ধ দেশ। ইরাকের তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছিল না বলেই ইরাককে ধ্বংসের পরিকল্পনা করে পশ্চিমের পরাশক্তিগুলো। আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন সাদ্দাম। ফলে প্রহসনমূলক এক বিচারে পরাজিত সাদ্দামকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলা হলে ‘ওয়ার অন টেরর’ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে আরব ও পশ্চিমা বিশ্ব। আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়ার বিরুদ্ধেও গৃহযুদ্ধে সহায়তা করলে গাদ্দাফির পতন হয়। সমাজতন্ত্র আর জাতীয়তাবাদের প্রতি গাদ্দাফির ঝোঁককে পশ্চিমি দেশগুলো মেনে নিতে পারেনি। ফলে কখনো রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অজুহাতে, কখনো গণতন্ত্রহীনতার অজুহাতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উসকানি দিয়েছে। একই ঘটনা ঘটিয়েছে মিসর, সিরিয়া ও ইয়েমেনে। হাফেজ আল-আসাদের সরকারের পতনে আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে তারা।
ইয়েমেনকেও আক্রমণ করা হয়েছে ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অজুহাতে। অভিযোগ আছে, সন্ত্রাসবাদের মদদ দিয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। সন্ত্রাসীদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা। আবার এই হামলার অজুহাতে সন্ত্রাসীদের নির্মূলের নামে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সরকার পতনেও রেখেছে ভূমিকা। এর সবই করা হয়েছে ভূরাজনীতি ও অর্থনীতির স্বার্থে।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে আরব-মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নির্মূল অথবা দমন করা। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য যাতে কখনো বৈশ্বিকভাবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারে, সেই চেষ্টাই করে চলেছে এখনো।
এই মুহূর্তে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইসরায়েল। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ। অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে যে দেশটি কথা বলছে বা কঠোর জাতীয়তাবাদী মনোভাব দেখাচ্ছে, সে হচ্ছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের জায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রবল বিরোধী ইরান। ফিলিস্তিনিদের ওপর বছরের পর বছর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল, ইরান ফিলিস্তিনিদের অর্থ-অস্ত্র দিয়ে তারও বিরোধিতা করছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর, যুক্তরাষ্ট্রের আপাতলক্ষ্য ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠাকে থামানো। বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই যুদ্ধে নেমে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কী পরিণাম ঘটবে এই যুদ্ধের? এর উত্তরের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সিএনএনের বিশ্লেষক স্টিফেন কলিনসন গতকালই একটা নিবন্ধে লিখেছেন, লিবিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তান নয় ইরান। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কী ঘটবে, সেটা না জেনেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ইরানের হাতে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো অস্ত্রও আছে। অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি, এমনকি সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলা চালাতে পারে ইরান। দেশটি (ইরান) সাইবার আক্রমণও করতে পারে। যুদ্ধ তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের মধ্যে চলে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
পশ্চিমারা আরব জাতীয়তাবাদবিরোধী যে ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে, তখন সেই জাতীয়তাবাদ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলোর জনসাধারণের মধ্যে।